
জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জ ও উইকিলিকসের কথা মনে আছে? ২০১০ থেকে ২০১১ সালের মধ্যে তারা আমেরিকাসহ বিভিন্ন দেশের ১৯৬৬-২০১০ সময়কার আড়াই লাখেরও বেশি মার্কিন গোপন নথি প্রকাশ করে। এসব নথিতে সৌদি আরব, ইরান, ইরাক, পাকিস্তান, আফগানিস্তান, ইয়েমেন ও ইউরোপের দেশগুলোর সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়, ইয়েমেনে গোপন ড্রোন হামলা, সৌদি রাজপরিবারের ইরানে হামলার আহ্বান এবং রাশিয়াকে ‘মাফিয়া রাষ্ট্র’ হিসাবে উল্লেখ করার তথ্য প্রকাশিত হয়। পরবর্তীকালে ২০১৬ সালে উইকিলিকস ডেমোক্রেটিক ন্যাশনাল কমিটির ই-মেইল ফাঁস করে, যা মার্কিন নির্বাচনে বড় প্রভাব ফেলে।
জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জ বিশ্বরাজনীতির গোপন যুদ্ধাপরাধ, মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং শক্তিধর রাষ্ট্রগুলোর সাম্রাজ্যবাদী ও দ্বিচারী চরিত্র উন্মোচনে নির্ভীক ভূমিকা রাখেন। সংবাদপত্রের স্বাধীনতা ও মানবাধিকারের পক্ষে সাহসী অবস্থানের জন্য তিনি বিশ্বব্যাপী আদর্শ হিসাবে বিবেচিত হন।
যুক্তরাষ্ট্র বহুদিন ধরেই নানা দেশের রাজনীতিতে নাক গলায়, কখনো সরাসরি হস্তক্ষেপ করে। বাংলাদেশের রাজনীতিতেও দীর্ঘকাল ধরে কতিপয় নেতা মার্কিনিদের মুখাপেক্ষী হয়েছিলেন এবং আছেন। তবে তাদের পরিচয় স্পষ্টভাবে সামনে আসে উইকিলিকসের নথি ফাঁসের পর। আমরা প্রচারমাধ্যমে রাজনীতিকদের যেসব মুখ দেখি, তা তাদের আসল রূপ নয়; মুখোশ পরে জনগণের সামনে আসেন তারা। সভা-সমাবেশে দেশপ্রেম, গণতন্ত্রের অঙ্গীকার ও জনদরদের কথা বললেও, বাস্তবে তাদের অবস্থান ভিন্ন। এ দুর্বলতার সুযোগ নেয় সামরিক বাহিনীর একাংশ, যাদের সহায়তা করে কিছু শিক্ষাবিদ, এনজিওকর্তা ও তথাকথিত বুদ্ধিজীবী। তারা ১/১১-এর সময় দুই নেত্রীকেই ‘মাইনাস’ করে নিজেদের পরিকল্পনা বাস্তবায়নের চেষ্টা করে-ভয় দেখানো, সুবিধার প্রলোভন দেখানো এবং বিদেশে পাঠানোর ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে। তখন দুই বড় দলের অনেক পরিচিত নেতাও এ ষড়যন্ত্রে অংশ নেন, যার বিশদ বিবরণ উইকিলিকসের তথ্য থেকে জানা যায়। ফখরুদ্দীন-মইনউদ্দীনের জরুরি অবস্থার সরকার ‘কিংস পার্টি’ গঠনের যে পরিকল্পনা করেছিল, তা ছিল গণতন্ত্রবিরোধী এক জঘন্য নীলনকশা। তবে নেতাদের রাজনৈতিক দক্ষতার কারণে নয়, বরং গণতন্ত্রকামী জনগণের দৃঢ় সচেতনতার ফলেই সেই ষড়যন্ত্র ব্যর্থ হয়।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে যুক্তরাষ্ট্রের হস্তক্ষেপের ইতিহাস দীর্ঘ। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে নিক্সন-কিসিঞ্জার প্রশাসন পাকিস্তানের পক্ষে অবস্থান নেয়, এমনকি সপ্তম নৌবহর বঙ্গোপসাগরে মোতায়েন করেছিল। স্বাধীন বাংলাদেশের স্বীকৃতিতেও যুক্তরাষ্ট্র বিলম্ব করে। ১৯৭৫ সালে শেখ মুজিব হত্যাকাণ্ড এবং খন্দকার মোশতাকের সরকার গঠনে মার্কিন ভূমিকা নিয়ে বিতর্ক আছে। ১৯৮২ সালে এরশাদের সামরিক শাসনেও মানবাধিকার লঙ্ঘনের সমালোচনা করলেও যুক্তরাষ্ট্র ভূরাজনৈতিক স্বার্থে তার পাশে থাকে। ২০২৫ সালে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন, আরাকান আর্মি ইস্যুতে বাংলাদেশের ওপর চাপ বাড়ায় এবং জাতিসংঘের মাধ্যমে ‘মানবিক করিডর’ প্রতিষ্ঠার কথা বলে।
যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থানকে খুবই গুরুত্বপূর্ণ মনে করে। বিশেষ করে ভারত মহাসাগর এবং দক্ষিণ চীন সাগরের সংযোগ রক্ষায়, চীনের ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ’ মোকাবিলায় এবং আঞ্চলিক নিরাপত্তা বজায় রাখতে বাংলাদেশকে কৌশলগত অংশীদার করতে চায়। গত তিন দশক ধরে যুক্তরাষ্ট্র বঙ্গোপসাগর অঞ্চলে সামরিক সহযোগিতা বাড়াতে আগ্রহ দেখিয়েছে এবং এ সময় বাংলাদেশের কিছু স্থানে ‘লজিস্টিক সাপোর্ট’, ‘ট্রেনিং বেস’ অথবা ‘রিফুয়েলিং স্টেশন’ নির্মাণের আগ্রহের কথা বলেছিল। বিশেষ করে সেন্টমার্টিন দ্বীপ বা কক্সবাজারের দিকে যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রহ ছিল ‘কৌশলগত প্রবেশপথ’ তৈরি করার বিষয়ে। চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সম্পর্ক (বড় বড় প্রকল্পে) বাড়ার পর বাংলাদেশ সরকার মার্কিন সামরিক উপস্থিতির প্রস্তাবকে অপ্রকাশ্যে বা নরমভাবে ঠেকিয়ে দিয়েছে। বর্তমানে ভূরাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে, বাংলাদেশ তার ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে আন্তর্জাতিক শক্তিগুলোর কৌশলগত আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে। বিশেষত বঙ্গোপসাগর ও ভারত মহাসাগরের সংযোগস্থলে অবস্থিত হওয়ায়, বাংলাদেশকে ঘিরে যুক্তরাষ্ট্র, চীন, ভারতসহ বেশ কয়েকটি শক্তির বিশেষ কৌশলগত পরিকল্পনা রয়েছে।
বাংলাদেশের নির্বাচনি প্রক্রিয়া বর্তমানে এক সংকটময় সময়ে রয়েছে, যেখানে রাজনৈতিক দল, গোষ্ঠী এবং আন্তর্জাতিক শক্তির চাপের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। নির্বাচন নানা গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুর ওপর নির্ভর করবে, যেমন-গণতন্ত্র, জাতীয় স্বার্থ এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্ক। এ কারণে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়িয়েছে, বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, চীন, ভারত এবং মিয়ানমারের সঙ্গে সম্পর্ক। মিয়ানমারের রোহিঙ্গা সংকট এবং যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ নির্বাচনি প্রক্রিয়ায় প্রভাব ফেলতে পারে।