
আস্থা-অনাস্থার সম্পর্ক বনাম মানবিক করিডর
দেশের রাজনীতি ক্রমেই জটিল থেকে জটিলতর হচ্ছে। সংস্কার এবং নির্বাচনের বিষয় তো আছেই। নির্বাচনের মধ্যেও এখন পর্যন্ত রয়েছে স্থানীয় সরকার, গণপরিষদ এবং জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রশ্ন। এরই মধ্যে নির্বাচনকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে আলোচনা শুরু হয়েছে সম্ভাব্য জোট গঠন কিংবা সমঝোতার সম্ভাবনা নিয়ে। অপেক্ষাকৃত নতুন প্রসঙ্গ হিসেবে রাজনীতির ময়দানে এসেছে নির্বাচনের আগে নির্বাচন কমিশনের (ইসি) পুনর্গঠনের প্রসঙ্গও। আর এই সবকিছু ছাপিয়ে বলতে গেলে ‘টক অব দ্য কান্ট্রি’ হয়ে উঠেছে মিয়ানমারের যুদ্ধবিধ্বস্ত অঞ্চলের বিপন্ন মানুষের জন্য সাহায্য-সহায়তা পৌঁছাতে জাতিসংঘের প্রস্তাবিত ‘মানবিক করিডর’।
এই রকম জটিল অবস্থার মধ্যে ১ মে আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবসে সম্পূর্ণ নতুন প্রসঙ্গ হিসেবে জনসমক্ষে এসেছে অন্তর্বর্তী সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে আস্থা-অনাস্থার বিষয়। মহান মে দিবস উপলক্ষে দেওয়া এক বাণীতে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, দেশকে নতুন করে গড়ে তুলতে ঐক্য, পারস্পরিক শ্রদ্ধা এবং আস্থার সম্পর্ক (সরকার ও রাজনৈতিক দল, শিল্পকারখানার মালিক ও শ্রমিক—সবার মধ্যে) জরুরি। অন্যদিকে, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) আয়োজিত ১ মের সমাবেশে দেওয়া ভার্চুয়াল বক্তব্যে দলটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বলেছেন, অনির্বাচিত সরকারের ওপর অনির্দিষ্টকাল আস্থা রাখা যৌক্তিক নয়। দেশের বিভিন্ন গণমাধ্যমে তাঁদের এই বক্তব্য প্রকাশিত হয়েছে।
পারস্পরিক আস্থার সম্পর্কে যে কিছুটা ভাটার টান পড়েছে, তা রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকমাত্রই উপলব্ধি করতে পারছেন। এই ভাটার টানের কারণ সংস্কার ও নির্বাচন নিয়ে টানাপোড়েন। বিএনপি চায় দ্রুত নির্বাচন। একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য অপরিহার্য সংস্কার সম্পন্ন করে এই নির্বাচনের দাবি তাদের অন্তর্বর্তী সরকারের শুরু থেকেই। অন্যদিকে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের সম্মুখ যোদ্ধারা (স্ট্রাইকিং ফোর্স) চায় রাষ্ট্রের আমূল সংস্কার শেষ করে নির্বাচন। এই চাওয়ার মধ্যেই সুপ্ত রয়েছে আস্থাহীনতা। এই যে জুলাই অভ্যুত্থানের সম্মুখ যোদ্ধাদের দাবি, এর পেছনে আছে রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি অবিশ্বাস বা আস্থাহীনতা। তাঁরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করেন যে নির্বাচনে জয়ী হয়ে এসব রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় গেলে রাষ্ট্রের আমূল সংস্কার করবে না। আস্থাহীনতার শুরু এই জায়গা থেকে।
এর একটি বিপরীত চিত্রও রয়েছে। তা হলো, রাজনৈতিক দলগুলোও জুলাই অভ্যুত্থানের সম্মুখ যোদ্ধাদের পুরোপুরি আস্থায় নিতে পারছে না। কারণ, অভ্যুত্থান সফল হওয়ার পর থেকেই ওই অভ্যুত্থানে রাজনৈতিক দলগুলোর ভূমিকা খাটো করে দেখার একটা প্রবণতা সম্মুখ যোদ্ধাদের মধ্যে লক্ষ করা গেছে। তাঁরা বিষয়টি প্রকাশ্যে বলে এসেছেন। তা ছাড়া, ওই সম্মুখ যোদ্ধারা রাষ্ট্রের এমন কিছু সংস্কারের কথা তুলেছেন, যা ক্রিয়াশীল বৃহৎ রাজনৈতিক দলগুলোর মনঃপূত নয়। তার মধ্যে রয়েছে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ এবং বাহাত্তরের সংবিধানের মূলনীতিগুলো ছেঁটে ফেলে দেওয়ার মতো স্পর্শকাতর বিষয়ও। এরূপ সংস্কারের লক্ষ্যে তাঁরা সর্বাগ্রে গণপরিষদ নির্বাচনের দাবি তুলেছিলেন। পরে অবশ্য তা কিছুটা সংশোধন করে একই সঙ্গে জাতীয় সংসদ ও গণপরিষদ নির্বাচনের কথা বলছেন। কিন্তু ক্রিয়াশীল রাজনৈতিক দলগুলো গণপরিষদ নির্বাচনের কোনো প্রয়োজনীয়তা বোধ করে না। তাদের দাবি দ্রুত নির্বাচন এবং নির্বাচিত সংসদের মাধ্যমে সংস্কারপ্রক্রিয়া বাস্তবায়ন।
জুলাই অভ্যুত্থানের সম্মুখ যোদ্ধাদের গঠিত রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম অতি সম্প্রতি বলেছেন, গণপরিষদ ছাড়া সংস্কার টেকসই হবে না। এর পাশাপাশি তাঁরা নির্বাচনের আগে বর্তমান নির্বাচন কমিশনেরও (ইসি) পুনর্গঠন প্রয়োজন বলে একটি নতুন বিষয় সামনে এনেছেন। বর্তমান ইসি অভ্যুত্থান-পরবর্তীকালে অন্তর্বর্তী সরকারের সময়েই গঠিত হয়েছে। কাজেই ঠিক কী কারণে এখন এই ইসির পুনর্গঠন দরকার, তা একটি প্রশ্ন হয়ে দেখা দিয়েছে। এইভাবে রাজনীতি ক্রমেই জটিল রূপ নিচ্ছে। এই অবস্থায় দেশে বেশ কিছু নতুন রাজনৈতিক দল গঠিত হয়েছে। এসব দলে সামরিক-বেসামরিক সাবেক আমলারা যোগ দিচ্ছেন। আগামী বছরের জুনের মধ্যে দেশে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে ধরে নিয়ে এসব রাজনৈতিক দল পরস্পরের মধ্যে আলাপ-আলোচনা শুরু করেছে। দেশের ইসলামপন্থী সমমনা দলগুলোও নিজেদের মধ্যে আলাপ-আলোচনা শুরু করেছে আগামী নির্বাচনের ‘এক বাক্সে ভোট আনা’র লক্ষ্যে। এসব উদ্যোগের অন্তর্নিহিত লক্ষ্য হলো নির্বাচনকেন্দ্রিক জোট কিংবা সমঝোতা গড়ে তোলা। নির্বাচন যদি সংখ্যানুপাতিক হয়, তাহলে এই নবগঠিত দলগুলোর জোট সংসদে আসনসংখ্যার দিক দিয়ে কিছুটা সুবিধাজনক অবস্থানে থাকতে পারে বলে অনেকের ধারণা।
রাজনৈতিক অঙ্গনের এই নানাবিধ জটিল অবস্থার মধ্যেও সবকিছু ছাপিয়ে সারা দেশে মুখ্য আলোচনা ও গণভাবনার বিষয় হয়ে উঠেছে মিয়ানমারের যুদ্ধবিধ্বস্ত অঞ্চলের বিপন্ন মানুষের জন্য সাহায্য-সহযোগিতা পৌঁছে দেওয়ার জন্য বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে একটি মানবিক করিডর চালু করা। প্রস্তাবটি এসেছিল জাতিসংঘের স্বয়ং মহাসচিবের কাছ থেকে, তাঁর অকস্মাৎ বাংলাদেশ সফরের সময়। পরে এ বিষয়ে জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা ও অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার রোহিঙ্গা সমস্যাবিষয়ক হাই রিপ্রেজেন্টেটিভ খলিলুর রহমান বার্তা সংস্থা এএফপির সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, জাতিসংঘের নেতৃত্বে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে মানবিক সহায়তা চালু তথা হিউম্যানিটারিয়ান করিডরের প্রস্তাবে বাংলাদেশ সায় দিয়েছে।