
স্ক্যাবিসের বিস্তার বাড়ছে দেশে, শুধুই কি সচেতনতার অভাব?
কয়েকদিন ধরে বিভিন্ন পত্রপত্রিকা ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বাংলাদেশে বিভিন্ন স্থানে স্ক্যাবিস (Scabies) ছড়ানোর বিষয়টি নিয়ে আলোচনা এবং সচেতনতা বৃদ্ধির কার্যক্রম চলছে। স্ক্যাবিস (Scabies) বা খোসপাঁচড়া একটি অত্যন্ত সংক্রামক চর্মরোগ, যা Sarcoptes scabiei নামক পরজীবী প্রাণী (mite) দ্বারা সংক্রমিত হয়। এটি ত্বকের সংস্পর্শে দ্রুত ছড়ায় এবং চুলকানি, ফুসকুড়ি ও ত্বকের ক্ষত সৃষ্টি করে।
বাংলাদেশে স্ক্যাবিসের বিস্তার দিন দিন বাড়ছে, বিশেষ করে বস্তি, শরণার্থী শিবির, গ্রামীণ এলাকা এবং ঘনবসতিপূর্ণ পরিবেশে। দারিদ্র্য, স্বাস্থ্য সচেতনতার অভাব এবং অপর্যাপ্ত চিকিৎসা সুবিধা এই রোগের প্রাদুর্ভাব বাড়িয়ে তুলছে।
স্ক্যাবিস কী?
স্ক্যাবিস বা খোসপাঁচড়া একটি অত্যন্ত সংক্রামক চর্মরোগ, যা Sarcoptes scabiei নামক এক প্রকার মাইক্রোস্কোপিক পরজীবী প্রাণী (mite) দ্বারা সৃষ্টি হয়। এই পরজীবী মানব ত্বকের ওপরের স্তরে (Stratum corneum) বাসা বেঁধে ডিম পেড়ে বংশবিস্তার করে, ফলে তীব্র চুলকানি, লাল ফুসকুড়ি এবং ছোট ছোট ফোসকার সৃষ্টি হয়। রোগটি সাধারণত হাতের আঙুলের ফাঁক, কব্জি, কোমর, নিতম্ব এবং জননাঙ্গের চারপাশে বেশি দেখা যায়। রাতে এই চুলকানি তীব্র আকার ধারণ করে, যা রোগীর স্বাভাবিক জীবনযাত্রাকে ব্যাহত করে।
স্ক্যাবিস কীভাবে ছড়ায়?
এই রোগ প্রধানত দুইভাবে সংক্রমিত হয়—প্রথমত, সরাসরি দীর্ঘস্থায়ী ত্বকের সংস্পর্শের মাধ্যমে (১৫-২০ মিনিটের বেশি), যেমন একই বিছানায় ঘুমানো বা ঘনিষ্ঠ শারীরিক সম্পর্ক। দ্বিতীয়ত, পরোক্ষভাবে আক্রান্ত ব্যক্তির ব্যবহৃত বস্তুর মাধ্যমে, বিশেষ করে তোয়ালে, কাপড়চোপড় বা বিছানার চাদর ব্যবহার করলে।
ঘনবসতিপূর্ণ পরিবেশ যেমন বস্তি, শরণার্থী শিবির, হোস্টেল বা শিশুদের আবাসিক প্রতিষ্ঠানে স্ক্যাবিস দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। সাধারণত সংস্পর্শের ৪-৬ সপ্তাহ পর লক্ষণগুলো প্রকাশ পায়, তবে যারা পূর্বে আক্রান্ত হয়েছে তাদের ক্ষেত্রে ১-৪ দিনের মধ্যেই লক্ষণ দেখা দিতে পারে।
বৈশ্বিক প্রাদুর্ভাব ও বোঝা
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ২০২২ সালের তথ্য অনুযায়ী, স্ক্যাবিস একটি বৈশ্বিক স্বাস্থ্য সমস্যা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে, যেখানে প্রতি বছর প্রায় ২০০ মিলিয়ন মানুষ আক্রান্ত হয়। উষ্ণমণ্ডলীয় ও উন্নয়নশীল দেশগুলোতে এই রোগের প্রকোপ সবচেয়ে বেশি, বিশেষ করে প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপপুঞ্জে ২০-৩০ শতাংশ জনসংখ্যা, ল্যাটিন আমেরিকার কিছু অঞ্চলে ১০-২০ শতাংশ শিশু এবং আফ্রিকার উপ-সাহারা অঞ্চলে ৫-১০ শতাংশ সাধারণ জনগোষ্ঠী স্ক্যাবিসে আক্রান্ত হয়।
দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশ ও প্রতিবেশী দেশ ভারতে এই রোগের ব্যাপক প্রাদুর্ভাব দেখা যায়, যেখানে ভারতে বছরে প্রায় ২৫ মিলিয়ন এবং বাংলাদেশে প্রায় ৫ মিলিয়ন মানুষ আক্রান্ত হয়। গ্রামীণ এলাকায় (৮-১২ শতাংশ) শহরাঞ্চলের (৫-৮ শতাংশ) তুলনায় সংক্রমণের হার বেশি।
স্ক্যাবিসের কারণে সৃষ্ট স্বাস্থ্য সমস্যা ও কাজ করার সক্ষমতা হারানোর ফলে বৈশ্বিক অর্থনীতিতে বছরে প্রায় ১০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ক্ষতি হয়, যা উন্নয়নশীল দেশগুলোর অর্থনৈতিক চাপ সৃষ্টিকারী। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এই রোগটিকে ‘গ্রীষ্মমণ্ডলীয় উপেক্ষিত রোগ (Tropical Neglected Diseases)’-এর তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করেছে, যা এর জনস্বাস্থ্য গুরুত্বকে আরও তুলে ধরে।
বাংলাদেশে স্ক্যাবিসের বিস্তার ও কারণ
বাংলাদেশে এই রোগটি আগে দেখা গেলেও মাঝে অনেক কমে গিয়েছিল। এই রোগটির বর্তমান বিস্তার হয়েছে প্রধানত টেকনাফের রোহিঙ্গা ক্যাম্প থেকে। ২০২৩ সালের মে মাসে, কক্সবাজারের রোহিঙ্গা শিবিরে পরিচালিত একটি সমীক্ষায় দেখা যায় যে, প্রায় ৪০ শতাংশ মানুষ স্ক্যাবিসে আক্রান্ত, কিছু শিবিরে এই হার ৭০ শতাংশ পর্যন্ত পৌঁছেছে।
- ট্যাগ:
- মতামত
- স্বাস্থ্য সচেতনতা
- স্ক্যাবিস