
অনলাইন জুয়া বন্ধের দায়িত্ব কার?
অনলাইন জুয়া এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ বিভিন্ন প্ল্যাটফর্মে এর প্রচার-প্রচারণা বন্ধের স্থায়ী সমাধান বের করতে সাত সদস্যের কমিটি গঠনের নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্য-প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের সচিব, তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের সচিব, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের সচিব, সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের সচিব, বিটিআরসির চেয়ারম্যান, পুলিশের আইজি ও বাংলাদেশ ফিন্যানশিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের প্রধানের প্রতি ২৭ এপ্রিল এই নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। কমিটি গঠনের ৯০ দিনের মধ্যে আদালতে এই বিষয়ে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে। এদিকে দেশে অনলাইন জুয়া নিষিদ্ধ করা হচ্ছে এবং এসবের সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িতদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে জানিয়েছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী এবং ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্য-প্রযুক্তি বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত ফয়েজ আহমেদ তৈয়্যব।
বলা বাহুল্য, বিজ্ঞান আমাদের প্রতিদিনের জীবনকে নানাভাবে জড়িয়ে ধরেছে নানা সার্থকতায়। আমাদের দৈনন্দিন জীবনের প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রে বিজ্ঞান আজ অপরিহার্য হয়ে পড়েছে। তবে বিজ্ঞানকে খারাপভাবে কাজে লাগালে তা অভিশাপ হবে এবং সেই দোষ বিজ্ঞানের নয়, মানুষের। কারণ মানুষই বিজ্ঞানকে বিপথে পরিচালিত করে।
বিজ্ঞানের কারণে সার্বিক যোগাযোগসহ অনেক কিছুই এখন হাতের মুঠোয়। ঠিক বিপরীতভাবে বিজ্ঞানের অপব্যবহার দেশ ও সমাজে সর্বনাশ ডেকে আনছে; যেমন—অনলাইন জুয়া। অনলাইন জুয়া এবং এর নেতিবাচক প্রভাব সম্পর্কে জানার আগে জুয়া সম্পর্কে সম্যক ধারণা থাকা প্রয়োজন। মূলত জুয়া বা বাজি হচ্ছে এমন একটি খেলা, যা লাভ বা লোকসানের মধ্যে ঝুলন্ত থাকে।
জুয়া খেলায় মূলত নির্দিষ্ট পরিমাণের অর্থ বা বস্তু (যা পুরস্কার হিসেবে ধার্য করা হয়) নির্ধারণ করা হয়। তারপর কোনো একটি বিষয়ে দুই পক্ষ চুক্তি করে হার-জিত নির্ধারণ করে। যে পক্ষ হেরে যায়, সে অপর পক্ষকে সেই নির্ধারিত অর্থ বা বস্তু প্রদান করে। এভাবে জুয়া খেলার জন্য তিনটি উপাদান উপস্থিত থাকে; যথা—বিবেচনা (বাজির পরিমাণ), ঝুঁকি (সুযোগ) এবং একটি পুরস্কার। এই খেলায় হেরে যাওয়া বা জিতে যাওয়া উভয় পক্ষেরই ঝুঁকি নিতে হয়।
এবার আসা যাক অনলাইন জুয়ার বিষয়ে। অনলাইন জুয়ায় অনলাইনে অংশগ্রহণ করে নগদ টাকা দিয়ে জুয়া খেলা অথবা গেমের ফলাফল হিসেবে বিভিন্ন পুরস্কার বা নগদ টাকা জেতার সুযোগ পাওয়ার জন্য টাকা-পয়সা বা অন্যান্য মূল্যবান সামগ্রী দিয়ে বা বাজি রেখে ইন্টারনেটে খেলা যায়। এমন গেম খেলতে ব্যবহারকারীকে উৎসাহ দেওয়া হয়। যেমন—অনলাইন ক্যাসিনো, অনলাইন লটারির টিকিট বা স্ক্র্যাচ কার্ড কেনা, খেলাধুলা সম্পর্কিত অনলাইন জুয়া ইত্যাদি। বিভিন্ন অ্যাপ খুলে চালানো হয় অনলাইন জুয়া, যা খেলা যায় দিনরাত ২৪ ঘণ্টা। ফলে দেশের স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী থেকে শুরু করে বেকার যুবকসহ অনেকেই অনলাইন জুয়া খেলায় জড়িয়ে যাচ্ছে এবং সব শেষে অনেকে নিঃস্ব হয়ে বখে যাচ্ছে। অনেকেই অফলাইন বা বাস্তবের মতো কৌতূহলবশত অনলাইন জুয়া খেলা শুরু করলেও পরে নেশায় পড়ে যাচ্ছে। ঠিক যেমনটি হয় মাদকের ক্ষেত্রে।
আসলে জুয়া হচ্ছে এক ধরনের প্রতারণার ফাঁদ। আর এই ফাঁদে পড়ে প্রতিনিয়তই নিঃস্ব হচ্ছে অসংখ্য মানুষ। একবার এই ফাঁদে পা দিলে সেখান থেকে বেরিয়ে আসা কঠিন। যেমনটি হয় হেরোইনে আসক্ত হলে। দেশের প্রচলিত আইনে জুয়া তথা অনলাইন জুয়া নিষিদ্ধ হলেও বর্তমানে তা চলছে গ্রাম থেকে শহর পর্যন্ত। অনলাইন জুয়ায় মানুষ মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে জুয়া খেলার টাকা লেনদেন করছে। আর যেহেতু অনলাইনে জুয়ার বিভিন্ন অ্যাপের সহজলভ্যতা রয়েছে, তাই যে কেউ ইচ্ছা করলেই অতি সহজে মোবাইল বা কম্পিউটারে জুয়া খেলার অ্যাপ দিয়ে ঘরে বসেই অ্যাকাউন্ট খুলে অনলাইনে জুয়া খেলতে পারে। আবার এসব অনলাইন জুয়ায় সাধারণ মানুষকে আকৃষ্ট করার জন্য জুয়ার সাইটগুলো কমিশনের ভিত্তিতে বিভিন্ন ধরনের এজেন্ট নিয়োগ দিয়ে থাকে। অনলাইনে বিভিন্ন অ্যাপের মাধ্যমে জুয়ার ফাঁদ পাতা হয়। লোভ দেখানো হয় এক দিনেই বড়লোক (!) হওয়ার। আর এসব ফাঁদে পা দিচ্ছে দেশের উঠতি বয়সী তরুণ, বেকার যুবকসহ অনেকেই। অনলাইন জুয়ায় প্রথমে লাভবান হয়ে পরবর্তী সময়ে লোভে পড়ে এক পর্যায়ে খোয়াচ্ছে মোটা অঙ্কের টাকা। আবার জুয়ার কারণে বাড়ছে পারিবারিক অশান্তি, মানসিক বিষণ্নতা, দাম্পত্য কলহ ইত্যাদি। জুয়া খেলার টাকা জোগাড় করার লক্ষ্যে দেশে বাড়ছে নানা ধরনের অপরাধ। বাংলাদেশে জুয়া নিষিদ্ধ হলেও জুয়ার সাইটের বিজ্ঞাপন বিভিন্ন ইউটিউব চ্যানেলসহ বিভিন্ন অনলাইন প্ল্যাটফর্মে প্রচার হতে দেখা যায়।
গণমাধ্যমে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, অনলাইন জুয়ায় দেশ থেকে বছরে পাচার হচ্ছে পাঁচ হাজার কোটি টাকার বেশি সম্পদ। এর আগে আইন-শঙ্খলা রক্ষা বাহিনী কর্তৃক প্রায় ২০০ জুয়ার ক্ষেত্র শনাক্ত করে সেসব ওয়েবসাইট লিংক বন্ধ করে দেওয়া হলেও তা বেড়েই চলেছে। বিটিআরসির এক প্রতিবেদন অনুসারে, সম্প্রতি ৩৩১টি জুয়ার সাইট দেশের অভ্যন্তরীণ নেটওয়ার্ক থেকে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। প্রতিটি জুয়ার সাইট দেশের বাইরে থেকে পরিচালিত হওয়ায় বাংলাদেশ থেকে প্রতিবছর বিপুল পরিমাণ অর্থ দেশের বাইরে চলে যাচ্ছে। অনলাইনে জুয়ারিদের একটি চক্র দেশের বাইরে থেকে এসব অনলাইন বিজ্ঞাপনের কার্যক্রম পরিচালনা করে। সেই সঙ্গে অনলাইনে অর্থ লেনদেনের সুযোগ থাকায় কোটি কোটি টাকাও বিদেশে পাচার হয়ে যাচ্ছে। কারণ এসব বেটিং অ্যাপ, ওয়েবসাইট বিদেশ থেকে পরিচালিত হয়। তাই এসব টাকা কোনো না কোনোভাবে বিভিন্ন হাত ঘুরে শেষ পর্যন্ত দেশের বাইরেই চলে যাচ্ছে।
দুঃখজনক হলেও সত্য, অনেক দেশেই জুয়া খেলা আইনগতভাবে বৈধ হওয়ায় অনলাইনে এর ব্যাপ্তি ক্রমেই বাড়ছে। ওয়ার্ল্ড গ্যাম্বলিং মার্কেট রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০২২ সালে শুধু অনলাইন জুয়ার বাজারমূল্য ছিল ছয় হাজার ৩৫৩ কোটি মার্কিন ডলার। ২০২৩ সালে এর ব্যাপ্তি বেড়ে দাঁড়ায় প্রায় ১১.৭ শতাংশ। অনলাইন জুয়ার বাজারমূল্য ক্রমেই ঊর্ধ্বমুখী। দেশে প্রচলিত আইনে জুয়া খেলা অবৈধ। কিন্তু এই আইন প্রণয়ন করা হয় ১৮৬৭ সালে (ব্রিটিশ আমলে)। আর এই আইনে সাজার পরিমাণও খুব নগণ্য। প্রকাশ্যে সরঞ্জামাদি ব্যবহার করে জুয়া খেলা হলে ১৮৬৭ সালের পাবলিক জুয়া আইনে ব্যবস্থা নেওয়া হয়। তবে অনলাইনে জুয়া খেলা হলে এই আইনে ব্যবস্থা নেওয়া যায় না। পাবলিক গ্যাম্বলিং অ্যাক্ট অনুযায়ী, যেকোনো ঘর, স্থান বা তাঁবু জুয়ার আসর হিসেবে ব্যবহৃত হলে তার মালিক বা রক্ষণাবেক্ষণকারী, জুয়ার ব্যবস্থাপক বা এতে কোনো সাহায্যকারী তিন মাসের কারাদণ্ড বা অনূর্ধ্ব ২০০ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন। এ রকম কোনো ঘরে তাস, পাশা, কাউন্টার বা যেকোনো সরঞ্জামসহ কোনো ব্যক্তিকে জুয়া খেলারত বা উপস্থিত দেখতে পাওয়া গেলে তিনি এক মাস পর্যন্ত কারাদণ্ড বা ১০০ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হতে পারেন। অর্থাৎ এই আইন শুধু প্রকাশ্য জুয়ার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য এবং দণ্ডবিধি বর্তমান সমাজের বাস্তবতার সঙ্গে উপযোগী নয়। তাই অনলাইনে জুয়া নিয়ন্ত্রণের জন্য অতি দ্রুত নতুন আইন প্রণয়ন করা এখন অপরিহার্য এবং সময়ের দাবিতে পরিণত হয়েছে।
- ট্যাগ:
- মতামত
- অনলাইন জুয়া