
নুরেমবার্গ থেকে ঢাকা: স্বীকারোক্তির আয়নায় স্বৈরাচার
মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারে সবচেয়ে দুরূহ অধ্যায়টি হলো শীর্ষ নেতৃত্বের ‘অভিপ্রায়’ বা অপরাধমূলক উদ্দেশ্য প্রমাণ করা। রাষ্ট্রপ্রধান বা সরকারের শীর্ষ নির্বাহীরা সাধারণত সরাসরি হত্যার আদেশে স্বাক্ষর করেন না; বরং তাঁদের নির্দেশাবলি প্রায়ই প্রতীকী, অলিখিত বা গোপনীয়তার চাদরে ঢাকা থাকে। ফলে নুরেমবার্গ থেকে হেগ পর্যন্ত আন্তর্জাতিক আদালতগুলোকে প্রায়ই ‘সারকামস্ট্যানশিয়াল এভিডেন্স’, প্রত্যক্ষদর্শীর সাক্ষ্য এবং বিক্ষিপ্ত নথিপত্র একত্র করে একটি অখণ্ড চিত্র নির্মাণ করতে হয়েছে।
এ ধরনের বিচারপ্রক্রিয়ায় রাষ্ট্রীয় কাঠামোর ভেতর থেকে আসা ‘স্বীকারোক্তি’ বা ‘রাজসাক্ষীর জবানবন্দি’ একটি মামলার মোড় ঘুরিয়ে দেওয়ার ক্ষমতা রাখে। এটি কেবল বিচ্ছিন্ন ঘটনাগুলোকে একটি সুসংবদ্ধ চেইন বা শৃঙ্খলে বাঁধে না, বরং সর্বোচ্চ পর্যায়ের ‘সুপিরিয়র রেসপনসিবিলিটি’ অর্থাৎ ‘শীর্ষ নেতৃত্বের দায়’ প্রতিষ্ঠা করার ক্ষেত্রে একটি অকাট্য সেতু হিসেবে কাজ করে।
২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টে বাংলাদেশে ছাত্র-জনতার ওপর সংঘটিত দমন-পীড়নের ঘটনাপ্রবাহ এই প্রেক্ষাপটে এক নতুন এবং শক্তিশালী আলোচনার জন্ম দিয়েছে।
এ ক্ষেত্রে কেবল আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর প্রমাণের সমাহারই ঘটেনি; বরং রাষ্ট্রযন্ত্রের শীর্ষ পর্যায় থেকে আসা স্বীকারোক্তিমূলক বয়ান এ ঘটনাকে ঐতিহাসিক অন্যান্য বিচারপ্রক্রিয়া থেকে স্বতন্ত্র করে তুলেছে।
আমরা জানি, আন্তর্জাতিক ফৌজদারি আইনে ‘স্বীকারোক্তি’ কেবল আদালতে আসামির নিজের মুখে দোষ স্বীকার করা নয়। এর পরিধি আরও ব্যাপক। একে কয়েকটি ভাগে ভাগ করা যায়:
প্রত্যক্ষ স্বীকারোক্তি: অভিযুক্ত ব্যক্তি বা তার ঘনিষ্ঠ সহযোগীর পক্ষ থেকে অপরাধ সংঘটনের সরাসরি স্বীকারোক্তি। যেমন কোনো ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার রাজসাক্ষী হিসেবে জবানবন্দি দেওয়া।
অনিচ্ছাকৃত স্বীকারোক্তি: অপরাধ ঢাকার চেষ্টায় বা আত্মপক্ষ সমর্থনে দেওয়া এমন কোনো বক্তব্য, যা অনিচ্ছাকৃতভাবে অপরাধের সঙ্গে সম্পৃক্ততা বা নীতির অস্তিত্ব প্রমাণ করে। যেমন সহিংসতাকে ‘রাষ্ট্রীয় প্রয়োজনে’ বা ‘উগ্রপন্থী দমনে’ অপরিহার্য ছিল বলে দাবি করা।
প্রামাণ্য স্বীকারোক্তি: ফাঁস হওয়া অডিও, ভিডিও বা গোপন নথি, যা অপরাধ সংঘটনের নির্দেশ বা পরিকল্পনাকে সুস্পষ্টভাবে প্রকাশ করে। এটি অজান্তেই তার নিজের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য হয়ে ওঠে।
আইনগতভাবে একটি শক্তিশালী স্বীকারোক্তি ‘চেইন অব কমান্ড’-এর দুর্বলতম গ্রন্থিগুলোকে সংযুক্ত করে। এটি মাঠপর্যায়ের সহিংসতা এবং শীর্ষ নেতৃত্বের নির্দেশের মধ্যে একটি সরাসরি ‘কার্যকারণ সম্পর্ক’ স্থাপন করে, যা অন্য কোনো প্রমাণের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠা করা প্রায়ই কঠিন। কিন্তু বাংলাদেশের ক্ষেত্রে জুলাই-আগস্টে যে প্রমাণগুলো উঠে এসেছে, তা এই তিন ধরনের স্বীকারোক্তির এক শক্তিশালী সমন্বয়।
- ট্যাগ:
- মতামত
- মানবতাবিরোধী অপরাধ
- স্বীকারোক্তি