বাংলাদেশে দারিদ্র্য বৃদ্ধি : এক অশনিসংকেত
সম্প্রতি বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, দেশে এখন দরিদ্র লোকের সংখ্যা ৩ কোটি ৬০ লাখ। ২০২৫ সাল শেষে দারিদ্র্যের হার ২১.২ শতাংশ হতে পারে। অথচ ২০২২ সালে এ হার ছিল ১৮.৭ শতাংশ। মাত্র ৩ বছরের ব্যবধানে দারিদ্র্যের হার বেড়েছে প্রায় ৩ শতাংশ। এই হিসাবে বছরপ্রতি ১ শতাংশ করে বাড়ছে। কয়েক দশক ধরে দারিদ্র্যের হার কমার পর ৪ বছর ধরে বাড়ছে। বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, ২০৫০ সাল নাগাদ ১.৩ কোটি মানুষ বাস্তুচ্যুত হতে পারে। বাস্তুচ্যুত হওয়ার জন্য একদিকে যেমন জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত কাজ করবে, অন্যদিকে দারিদ্র্যের দুষ্টচক্রে পড়ে অনেক মানুষ বাস্তুহারা হতে পারে। আঞ্চলিক দারিদ্র্যবৈষম্য আরও বৃদ্ধি পেতে পারে একই সঙ্গে।
দারিদ্র্য বৃদ্ধির মূল কারণ হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছে উচ্চ মূল্যস্ফীতি ও কর্মসংস্থান কম হওয়াকে। বিগত বছরগুলোয় মূল্যস্ফীতি যে বল্গাহীন হয়ে পড়েছিল সে ব্যাপারে প্রশ্ন তোলার কোনো সুযোগ নেই। সরকারিভাবে শেখ হাসিনার আমলে মূল্যস্ফীতির হার ১০ শতাংশের কিছু কম করে দেখানো হতো। কারণ মূল্যস্ফীতির অঙ্ক ডাবল ডিজিট হলে অর্থনীতির জন্য তা রেড লাইট ডেঞ্জার হয়ে ওঠে। পরিসংখ্যানে কারচুপি করা আওয়ামী সরকারের একটি অভ্যাসে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। নিজেদের দুর্বলতা ঢাকতে পরিসংখ্যানকে শোভন করে দেখানোর অপপ্রয়াস চালানো হয়। তবে অনেক অর্থনীতিবিদের ধারণা, সরকারিভাবে প্রদত্ত মূল্যস্ফীতির হার বাস্তবে ১০ শতাংশেরও বেশি ছিল।
মূল্যস্ফীতি বাড়লে দারিদ্র্য কেন বাড়বে, তা একটি যৌক্তিক প্রশ্ন। আমাদের দেশের মূল্যস্ফীতির অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, খাদ্য মূল্যস্ফীতি খাদ্যবহির্ভূত মূল্যস্ফীতির চেয়ে বেশি। স্বল্প ও নিম্ন-আয়ের মানুষের জন্য খাদ্য মূল্যস্ফীতি আশঙ্কার কারণ। নিম্ন-আয়ের লোকদের পক্ষে জীবনের জন্য অতি প্রয়োজনীয় খাদ্যসামগ্রীর দাম বেশি হলে তাদের পক্ষে বেঁচে থাকা কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। দাম বেশি হলে বাধ্য হয়ে খাদ্যসামগ্রী কেনায় কাটছাঁট করতে হয়, অথবা উচ্চমূল্যের খাদ্যসামগ্রী সস্তা মূল্যের খাদ্যসামগ্রী দিয়ে পোষাতে হয়। এতে নিম্ন-আয়ের মানুষ পুষ্টিমানের দিক থেকে অপ্রতুলতায় ভোগে। পুষ্টির অভাবে তারা নানা রকমের রোগব্যাধিতে আক্রান্ত হয়।
অসুখ-বিসুখের চিকিৎসা করাতে গিয়ে তাদের আরও সর্বস্বান্ত ও ঋণের জালে জড়াতে হয়। এভাবে দারিদ্র্য আরও প্রকট হয়ে ওঠে। দারিদ্র্যসীমার কিছু উপরে যারা অবস্থান করে, তারা দারিদ্র্যসীমার নিচে তলিয়ে যায়। অন্যদিকে যারা দারিদ্র্যসীমার নিচে অথচ কাছাকাছি থাকে, তারা চরম দারিদ্র্যে নিপতিত হয়। এ কথা জানা দরকার যে, দরিদ্র লোকদের মধ্যেও বৈষম্য থাকে। কেউ অল্প দরিদ্র, আবার কেউ বেশি দরিদ্র। এজন্য পোভার্টি গ্যাপের হিসাব করা হয়।
দারিদ্র্য মোকাবিলা করার জন্য সরকারের অনেক ধরনের সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচি রয়েছে। বিভিন্ন নামে ও বিভিন্ন আকারে দরিদ্র লোকদের হাতে কিছু অর্থ পৌঁছে দিয়ে তাদের ক্রয়ক্ষমতায় শক্তি জোগানোই এসব সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির উদ্দেশ্য। তবে দুর্ভাগ্যের বিষয়, দুর্নীতি, ক্ষমতা কাঠামোয় বৈষম্য ও দলবাজির কারণে সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির অর্থ প্রকৃত দরিদ্র লোকদের হাতে পৌঁছায় না। এ অর্থের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ তাদের হাতে চলে যায়, যাদের এ সহায়তা পাওয়ার কথা নয়।
বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, সবচেয়ে ধনী ২০ শতাংশ পরিবারের ৩৫ শতাংশ এই সুবিধা পায়। অন্যদিকে দরিদ্রতম ২০ শতাংশ পরিবারের মাত্র অর্ধেক এ সুবিধা পায়। সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচিতে এ ধরনের ছিদ্র থাকার ফলে এ কর্মসূচিটি ভন্ডুল হওয়ার উপক্রম হয়েছে। সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচি একধরনের বাজেটারি ট্রান্সফার। সাধারণভাবে জনগণের কাছ থেকে যে কর আদায় করা হয়, তারই একটি অংশ সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির জন্য বরাদ্দ দেওয়া হয়। সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির বিকৃতি সাধারণ কর প্রদানকারীদের প্রতি অবজ্ঞা ও অন্যায়ের শামিল।
দেশের জনসংখ্যর বড় একটি অংশ দারিদ্র্যসীমার কিছুটা উপরে থাকে। তারা উচ্চ মূল্যস্ফীতি ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের মতো বিভিন্ন আঘাতের কারণে দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে যাওয়ার ঝুঁকিতে থাকে। বিশ্বব্যাংকের হিসাবে ২০২২ সালে সংখ্যাটি ছিল ৬ কোটি ২০ লাখ। অর্থাৎ ২০২২ সালে দারিদ্র্যসীমার সামান্য ওপরে থাকা মানুষ সমগ্র জনসংখ্যার এক-তৃতীয়াংশের মতো। এদের অবস্থা খুবই ভঙ্গুর। সামান্য বিপর্যয়ে তাদের দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে যাওয়ার শঙ্কা থাকে। দারিদ্র্য বিমোচনকে টেকসই করতে হলে নিশ্চিত করতে হবে এরা যেন সাময়িক বিপর্যয়ের আঘাতে দারিদ্র্যসীমার নিচে তলিয়ে না যায়। এটি বলা যত সহজ, করা তত সহজ নয়। সামগ্রিক অর্থনীতির টেকসই প্রবৃদ্ধি না হলে এ প্রবণতা স্থায়ীভাবে রোধ করা সম্ভব হবে না। নিশ্চিত করতে হবে এরা যেন স্থায়ীভাবে ও নিয়মিত কর্মসংস্থান পেতে পারে।
দেশে দারিদ্র্যের হার হিসাব করে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস)। সংস্থাটির খানা আয়-ব্যয় জরিপে এ তথ্য উঠে আসে। সর্বশেষ খানা আয়-ব্যয় জরিপ করা হয়েছিল ২০২২ সালে। তখন সার্বিক দারিদ্র্যের হার ছিল ১৮.৭ শতাংশ। একটি পর্যায়ে দারিদ্র্য পরিস্থিতির অগ্রগতি দেখে মনে করা হয়েছিল, বাংলাদেশে খাদ্য নিরাপত্তা চিন্তায় পরিবর্তন প্রয়োজন। এ চিন্তা থেকে মনে করা হয়েছিল, শর্করাজাতীয় খাদ্যের পাশাপাশি আমিষ ও শাকসবজিজাতীয় খাদ্য যোগ করাই খাদ্য নিরাপত্তা অর্জনের পরবর্তী ধাপ। কিন্তু দারিদ্র্য পরিস্থিতির অবনতি দেখে মনে হচ্ছে সেই আশাবাদ ধরে রাখার কোনো সুযোগ নেই। আমরা যে তিমিরে ছিলাম, সেই তিমিরেই ডুবে যাচ্ছি।
বিশ্বব্যাংকের হিসাবটি মূলত প্রাক্কলন, যা করা হয়েছে ‘মাইক্রো-সিমুলেশন মডেল’ নামের একটি পদ্ধতি ব্যবহার করে। শ্রমবাজারের গতিশীলতা, প্রবাসী আয় এবং সরকারের ভর্তুকি ব্যয়কে ভিত্তি করে মাইক্রো-সিমুলেশন মডেলে দারিদ্র্যের হার পর্যালোচনা করা হয়েছে বলে জানিয়েছে বিশ্বব্যাংক।