
বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরুদ্ধে ট্রাম্পের যুদ্ধ নিয়ে তোলপাড়
যুক্তরাষ্ট্রের বড় বড় বিশ্ববিদ্যালয় মানেই বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়। হার্ভার্ড, স্ট্যানফোর্ড, কলাম্বিয়া, এমআইটি, ইয়েল, কর্নেল, ব্রাউন, জর্জটাউন, প্রিন্সটন, ডিউক, কার্নেগি মেলন, জন হপকিন্স, ইউনিভার্সিটি অফ সাউদার্ন ক্যালিফোর্নিয়াসহ যতগুলো শীর্ষস্থানীয় আমেরিকান বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম দুনিয়াজুড়ে শিক্ষিত লোকজন জানেন, সবই প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়। প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প দায়িত্ব গ্রহণের পর শত শত বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজের ফেডারেল বিপুল পরিমাণ তহবিল বন্ধ করাসহ অন্যান্য নজিরবিহীন প্রতিশোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের উদ্যোগ নিয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্রে ডেমোক্রেট অথবা রিপাবলিকান, যারাই হোয়াইট হাউজ দখল করুক না কেন, উভয় দলের প্রশাসনে এসব বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রতিনিধিত্ব থাকা অবধারিত। আমেরিকান নীতিনির্ধারণেও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মুখ্য ভূমিকা থাকে। কোনো প্রশাসনই বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাধীনতা কোনোভাবে খর্ব করার চেষ্টা করে না, সাহসও করে না। ট্রাম্প প্রশাসনের উদ্যোগের বিরুদ্ধে ফুঁসে উঠেছে আমেরিকার শত শত বিশ্ববিদ্যালয়।
কিন্তু ট্রাম্প বলে কথা। সবাইকে তার অঙ্গুলি হেলনে চলার চর্চা শুরু করতে হবে। তিনি হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো বিশ্বখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়ের ২.৩ বিলিয়ন ডলারের তহবিল প্রত্যাহার করে নেওয়ার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেছেন। অভিজাত আমেরিকান বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বিরুদ্ধে একটি বিস্তৃত প্রচারণা ছড়িয়ে এমন একটি পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে, যা শিক্ষাবিষয়ক স্বাধীনতার ওপর প্রশাসনের প্রত্যক্ষ আক্রমণ হিসাবে বিবেচনা করা হচ্ছে। ডিপার্টমেন্ট অফ জাস্টিসসমর্থিত টাস্কফোর্সের এ সিদ্ধান্ত উচ্চশিক্ষায় আদর্শিক সংস্কার কার্যকর করার মাসব্যাপী প্রচেষ্টায় সবচেয়ে আক্রমণাত্মক পদক্ষেপ। হার্ভার্ড একক প্রতিষ্ঠান নয়। কলাম্বিয়া থেকে কর্নেল, প্রিন্সটন, পেনসিলভেনিয়া বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত ৬০০টির বেশি প্রতিষ্ঠান ফেডারেল তদন্ত, তহবিল স্থগিতাদেশ বা তীব্র তদন্তের মুখোমুখি হচ্ছে। এর প্রতিক্রিয়াও প্রচণ্ড। বিশ্ববিদ্যালয় নেতৃবৃন্দ, সিভিল সোসাইটি এবং আইন বিশেষজ্ঞরা যুক্তি প্রদর্শন করেছেন, প্রশাসন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের স্বাধীনতার ওপর রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ আরোপের জন্য নাগরিক অধিকার আইন লঙ্ঘন করতে যাচ্ছে।
ঘটনাটি ঘটেছে গত ১৪ এপ্রিল, যখন ডিপার্টমেন্ট অফ এডুকেশনের অ্যান্টি-সেমিটিজম টাস্কফোর্স-ডিপার্টমেন্ট অফ জাস্টিসের সিভিল রাইটস বিভাগের অধীনে পরিচালিত-ঘোষণা করেছে, তারা হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়কে ২.২ বিলিয়ন ডলারের গবেষণা অনুদান এবং আরেকটি চুক্তির অধীনে ৬০ মিলিয়ন ডলার স্থগিত করছে। ট্রাম্প প্রশাসন ঘোষণা করেছে, তারা হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন পর্যালোচনা নিয়ে তদন্ত শুরু করছে এবং তারা জাতিভিত্তিক বৈষম্য সম্পর্কে অভিযোগের সত্যতা পেয়েছে। তারা হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে সুস্পষ্টভাবে অভিযুক্ত করেছেন, হার্ভার্ড তাদের ইহুদি ছাত্রদের বৈষম্য ও ক্যাম্পাসে হয়রানির শিকারে পরিণত হওয়া থেকে রক্ষা করতে ব্যর্থ হয়েছে। হার্ভার্ডসহ যুক্তরাষ্ট্রের অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিশ্ববিদ্যালয়ে গাজায় ইসরাইলের হামলা ও গণহত্যা পরিচালনার বিরুদ্ধে গত বছর ক্যাম্পাসে ব্যাপক বিক্ষোভের পরিপ্রেক্ষিতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের ব্যর্থতার কারণে ট্রাম্প প্রশাসন প্রতিশোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতেই বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ফেডারেল অনুদান বন্ধ করার উদ্যোগ নিয়েছে।
হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় বেশকিছু অযৌক্তিক ফেডারেল দাবি মানতে অস্বীকৃতি জানালে প্রশাসন এ পদক্ষেপ গ্রহণের ঘোষণা দেয়। যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানের প্রথম সংশোধনী অনুযায়ী, ফেডারেল সরকারের পক্ষে বেসরকারি উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে এ ধরনের কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করা সম্ভব নয়। তবে হার্ভার্ডের মতো বিশ্ববিদ্যালয়ও ফেডারেল অর্থ না পেলে সাময়িক অসুবিধার মধ্যে পড়তে পারে। সেজন্য ইতোমধ্যে হার্ভার্ড বেসরকারি উৎস থেকে ৭৫০ মিলিয়ন ডলার সংগ্রহ করার উদ্যোগ নিয়েছে।
ট্রাম্প প্রশাসনের পক্ষে শেষ পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ফেডারেল তহবিল প্রত্যাহার করা সম্ভব হবে, এমন মনে হয় না। হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় ইতোমধ্যে আইনি লড়াই শুরু করেছে। এজন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে নিজস্ব তহবিল ব্যয় করা ছাড়াও ইতোমধ্যে হার্ভার্ডের ৮৪ জন শিক্ষক তাদের বেতনের ১০ শতাংশ আইনি তহবিলে দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন, যার পরিমাণ আড়াই মিলিয়ন ডলার। শিক্ষকদের সংগঠকরা বলেছেন, ট্রাম্প প্রশাসনের বেআইনি দাবিগুলো বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ প্রত্যাখ্যান করে যথাযথ কাজ করেছে এবং এ ব্যাপারে আমরা একমত। আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার স্বাধীনতা রক্ষার জন্য গুরুতর আর্থিক ক্ষতির মুখোমুখি হতেও সম্মত। মামলায় হার্ভার্ড দাবি করেছে, ট্রাম্প প্রশাসন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক নীতিমালার ওপর হস্তক্ষেপ করে ১৯৪৬ সালের আইন লঙ্ঘন করেছে। বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন পরিচালনার আইন আমলে নিয়ে আদালতকে ট্রাম্প প্রশাসনের উদ্যোগকে বেআইনি বিবেচনা করতে হবে। কারণ, তারা বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনার চূড়ান্ত কোনো কর্তৃপক্ষ নয়। তারা যে পদক্ষেপ নিয়েছে, তা বিবেচনাপ্রসূত নয়, কৌতুকপূর্ণ, নির্বিচার, প্রশাসনিক বিচক্ষণতার অপপ্রয়োগ এবং কোনোভাবেই আইনানুগ নয়।
ট্রাম্প প্রশাসন গত মাসে হার্ভার্ডের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ গ্রহণের আগে বিশ্ববিদ্যালয়কে পরোক্ষভাবে হুমকি দিয়ে বলেছিল, তারা হার্ভার্ডকে বিগত বছরগুলোতে দেওয়া প্রায় ৯ বিলিয়ন ডলারের গবেষণা অনুদান এবং চুক্তি পর্যালোচনা করছে। একইসঙ্গে তারা ক্যাম্পাসে সেমিটিকবিরোধী বিক্ষোভ ও আচরণের অভিযোগগুলোও আরও নিবিড়ভাবে তদন্ত করেছে। এছাড়া হার্ভার্ডের নেতৃত্বে সংস্কার আনার দাবিও তুলেছে প্রশাসন। এমনকি তারা হার্ভার্ড কর্তৃপক্ষের কাছে এমন হুমকিও দিয়েছিল যে, তারা যদি ফেডারেল অনুদান লাভ অব্যাহত রাখতে চায়, তাহলে তাদের অন্তর্ভুক্তিমূলক নীতিমালার অবসান ঘটাতে হবে।