বাংলাদেশের গণমাধ্যম: সংকট থেকে বের হয়ে আসার পথ কী
গণমাধ্যমে প্রতিনিয়ত উঠে আসে সমাজের বহুমুখী সংকটের চিত্র। এসব সংকটের ভিড়ে খোদ গণমাধ্যমের সংকটই আড়ালে পড়েছে। সংকট নিয়েই গণমাধ্যমের যাত্রা শুরু। সুষ্ঠু পরিকল্পনার অভাবে দিন দিন এই সংকট আরও তীব্র হচ্ছে। সংকটের সুযোগ নিয়ে একটি শ্রেণি গণমাধ্যমকে নিয়ন্ত্রণ করছে। রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভখ্যাত এই গণমাধ্যমকে সংকটে রেখে দেশে কখনো সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়।
গত তিন দশকে বেসরকারি খাতের গণমাধ্যমে যে ব্যাপক বিকাশ ঘটেছে, তা মূলত অপরিকল্পিত। যারা যেভাবে পেরেছে, গণমাধ্যমে বিনিয়োগ করেছে। গণমাধ্যমে বিনিয়োগের উৎস নিয়ে তেমন কোনো প্রশ্ন তোলা হয়নি। এর ফলে গণমাধ্যমে রাজনৈতিক প্রভাব পড়েছে। অনেকেই নিজেদের ব্যবসাকে সুরক্ষা দেওয়ার জন্য গণমাধ্যমকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করেছে।
আবার একই গোষ্ঠীর মালিকানায় একাধিক সংবাদপত্র, রেডিও, টেলিভিশন ও অনলাইন পত্রিকা পরিচালিত হচ্ছে। এর ফলে গণমাধ্যমে গোষ্ঠীগত প্রভাব কেন্দ্রীভূত হচ্ছে। এতে গণমাধ্যমে সুষ্ঠু প্রতিযোগিতার পরিবেশ যেমন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে, তেমনি গণমাধ্যমের বিশ্বাসযোগ্যতা কমেছে এবং গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানের ব্যবসায়িক ভিত্তিও দুর্বল হচ্ছে। গণমাধ্যম সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনে একই মালিকানার অধীন একাধিক গণমাধ্যম বন্ধ করার সুপারিশ করা হয়েছে।
গণমাধ্যমের আরেকটি সংকট হলো আইনগত সংকট। গণমাধ্যম-সংশ্লিষ্ট এমন কিছু আইন আছে, যা গণমাধ্যমের স্বাধীনতার জন্য প্রতিবন্ধক। গণমাধ্যম ও সাংবাদিকতার জন্য প্রযোজ্য এমন কিছু আইনের সংস্কারে গণমাধ্যম সংস্কার কমিশন সুপারিশ করেছে। কমিশন মনে করে, সংবিধানে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা স্বীকৃত হলেও তাতে কিছু অস্পষ্টতা ও অযৌক্তিক সীমাবদ্ধতা আরোপ করা হয়েছে।
এ ছাড়া ব্রিটিশ আমল থেকে প্রচলিত কিছু আইন বাক্স্বাধীনতা ও মুক্ত সংবাদমাধ্যমের পথে বাধা সৃষ্টি করে আসছে। এর পাশাপাশি বেশকিছু নতুন আইন প্রণীত হয়েছে, যার ফলে স্বাধীন সাংবাদিকতা ব্যাপকভাবে সংকুচিত হয়েছে। গণমাধ্যম সংস্কার কমিশনের মতে, স্বাধীন সাংবাদিকতার বিকাশে পেনাল কোড (দণ্ডবিধি) ১৮৬০, ফৌজদারি কার্যবিধি ১৮৯৮-সহ আরও কয়েকটি আইনের সংশোধন প্রয়োজন। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার ইতিমধ্যে সাইবার নিরাপত্তা আইন বাতিল করে সাইবার সুরক্ষা অধ্যাদেশের খসড়া চূড়ান্ত করেছে।
বাক্স্বাধীনতা ও বস্তুনিষ্ঠ তথ্য প্রকাশের চর্চার মতো সুরক্ষিত অধিকারের জন্য সাংবাদিকদের বিভিন্ন সময়ে হয়রানি ও শারীরিক আক্রমণের শিকার হতে হয়। সাগর-রুনি দম্পতির বহুল আলোচিত হত্যাকাণ্ডের বিচার না হওয়ায় জনধারণা তৈরি হয়েছে যে সাংবাদিকদের মারলে কিছুই হয় না। বিদ্যমান বাস্তবতা বিবেচনা করে গণমাধ্যম সংস্কার কমিশন সাংবাদিকতার অধিকার সুরক্ষা অধ্যাদেশ প্রণয়নের সুপারিশ করেছে। কমিশনের প্রতিবেদনে সাংবাদিকতার অধিকার সুরক্ষা অধ্যাদেশের একটি খসড়াও সংযুক্ত করা হয়েছে।
বাংলাদেশে গণমাধ্যমের কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ ও তদারকির ক্ষেত্রেও বেশ কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে। বাংলাদেশের সব ধরনের গণমাধ্যমের কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ, তদারকি ও মূল্যায়নের জন্য এখনো কোনো বিশেষ প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেনি। বিষয়টি বিবেচনা করে গণমাধ্যম সংস্কার কমিশন বাংলাদেশ গণমাধ্যম কমিশন গঠনের প্রস্তাব করেছে। এই কমিশন হবে সরকারের নিয়ন্ত্রণমুক্ত। গণমাধ্যম কমিশন সাংবাদিকদের আচরণবিধি প্রণয়ন ও প্রতিপালন নিশ্চিত করার পাশাপাশি সাংবাদিকদের ন্যূনতম শিক্ষাগত যোগ্যতা নির্ধারণ, সারা দেশে কর্মরত সাংবাদিকদের নিবন্ধন ও তালিকা প্রস্তুত করবে। সম্প্রচার ও অনলাইন সংবাদমাধ্যমের লাইসেন্স দেওয়ার এখতিয়ারও থাকবে প্রতিষ্ঠানটির হাতে।
বাংলাদেশে সংবাদপত্রের প্রচারসংখ্যা বাড়িয়ে দেখানোর একটা প্রবণতা লক্ষ করা যায়। প্রচারসংখ্যা বাড়ানোর পেছনে মূলত দুটি কারণ রয়েছে। প্রথমত, বিজ্ঞাপনের জন্য বাড়তি দর আদায়; দ্বিতীয়ত, কম শুল্কে নিউজপ্রিন্ট আমদানি করে খোলাবাজারে বিক্রি করে বাড়তি আয় করা। এসব অসংগতি বন্ধে সংবাদপত্রের সঠিক প্রচারসংখ্যা নির্ধারণ করা খুবই জরুরি। সংবাদপত্রের প্রচারসংখ্যা তদারকির দায়িত্বে রয়েছে চলচ্চিত্র ও প্রকাশনা অধিদপ্তর (ডিএফপি)। কিন্তু বাস্তবতা হলো, প্রতিষ্ঠানটি এখনো মুদ্রিত সংবাদপত্রের বিশ্বাসযোগ্য প্রচারসংখ্যা নিশ্চিত করতে পারেনি।