
সাংবাদিকের পেশাগত অনিশ্চয়তা দূর করতে হবে
একটা সময় পর্যন্ত মনে করা হতো সাংবাদিকতা হচ্ছে সৌখিন ও স্বচ্ছল লোকের সন্তানদের পেশা— যাদেরকে মাস শেষে বেতনের চিন্তা করতে হয় না। বিশেষ করে ঢাকার বাইরে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের স্থানীয় প্রতিনিধি হিসেবে যারা একসময় কাজ করতেন, তাদের বিরাট অংশের জন্যই এটা ছিল সেকেন্ডারি বা দ্বিতীয় কাজ। অর্থাৎ তিনি হয়তো শিক্ষকতা করেন বা অন্য কোনো চাকরি করেন, ব্যবসা করেন— তার ফাঁকে সাংবাদিকতাটাও করেন এক-আধটু। এটা ততক্ষণ পর্যন্ত সম্ভব ছিল যতক্ষণ না ইন্টারনেট ও সোশ্যাল মিডিয়া বিকশিত হয়েছে। যতক্ষণ না প্রতি মুহূর্তের খবর জানানোর প্রয়োজন অনুভূত হয়েছে। যতক্ষণ না টেলিভিশন ও অনলাইন সংবাদমাধ্যমের বিকাশ ঘটেছে। ফলে একটা সময় পর্যন্ত স্থানীয় পর্যায়ের সাংবাদিকরা দিনের সব কাজ সেরে সন্ধ্যায় প্রেসক্লাবে গিয়ে কোনোদিন একটি, কোনোদিন দুটি সংবাদ ফ্যাক্সে ঢাকা অফিসে পাঠাতেন। কোনো কোনোদিন হয়তো একটিও না। আর সংবাদের সংশ্লিষ্ট ছবি এবং বিশেষ সংবাদ ও ছবি পাঠাতেন ডাকে। সেই সংবাদ ও ছবি পরদিন পত্রিকা অফিসে পৌঁছাত। ছাপা হতো তারও দুয়েকদিন পরে। খুব জরুরি হলে অন্য কোনো উপায়ে সংবাদ ও ছবি পাঠানো হতো। যারা স্থানীয় পর্যায়ে এই ধরনের সাংবাদিকতা করতেন, তারা সামাজিকভাবে বেশ সম্মানীয় মানুষ হলেও মাস শেষে তাদের অধিকাংশই কোনো সম্মানি পেতেন না। সম্মানির ব্যাপারে তাদের খুব একটা চাওয়াও ছিল না। কারণ তারা পত্রিকার পাতায় নিজের নামটি ছাপার অক্ষরে দেখে আনন্দ পেতেন। একইসঙ্গে নিজের এলাকার সমস্যা-সম্ভাবনা তুলে ধরার মধ্য দিয়ে একধরনের সামাজিক দায়িত্ব পালন করছেন বলে বিশ্বাস করতেন। ফলে সেখানে সম্মানির বিষয়টা ততটা গুরুত্বপূর্ণ ছিল না।
কিন্তু এই পুরো দৃশ্যপট বদলে দিয়েছে কম্পিউটার ও ইন্টারনেট। যার মাধ্যমে মুহূর্তেই সংবাদ, ছবি এমনকি ভিডিও পাঠানো যাচ্ছে। ফলে চাহিদাও বেড়েছে। যারা একসময় সারা দিনের কাজ সেরে হেলেদুলে, চা খেতে খেতে, গল্প করতে করতে সংবাদ লিখতেন এবং ধীরে সুস্থে ফ্যাক্সে পাঠাতেন, উপরন্তু যারা কম্পিউটার ও ইন্টারনেটের আধুনিক প্রযুক্তির সঙ্গে নিজেকে খাপ খাওয়াতে ব্যর্থ হয়েছেন— তারা ক্রমশই অপ্রাসঙ্গিক হয়ে গেছেন। সেটা জাতীয় পর্যায়ে তো বটেই, স্থানীয় পর্যায়েও।
এখন কোনো পত্রিকা, টেলিভিশন বা অনলাইন সংবাদমাধ্যমের উপজেলা প্রতিনিধিকেও কম্পিউটারে লিখতে জানতে হয়। ইন্টারনেটে সংবাদ পাঠাতে হয়। সোশ্যাল মিডিয়ার উপযোগী কনটেন্ট তৈরি কিংবা কনটেন্টের কাঁচামাল সরবরাহ করতে হয়। এমনকি তাদেরকে ঘটনাস্থল থেকে অথবা বিভিন্ন বিষয়ে লাইভে বা সরাসরি কথা বলতে হয়। এসব কারণে স্থানীয় পর্যায়েও এখন বিপুল সংখ্যক তরুণ সাংবাদিকতায় এসেছেন, আসছেন। প্রশ্ন হলো, তারা কি এই কাজগুলো আর আগের প্রজন্মের মতো বিনা পয়সায় কিংবা নামমাত্র সম্মানিতে করবেন? নিশ্চয়ই করবেন না। এখন স্থানীয় পর্যায়েও এরকম লোক খুঁজে পাওয়া কঠিন হবে যারা শুধুমাত্র পত্রিকার পাতায় নিজের নাম ছাপানো এবং নিজের এলাকার খবর দিয়ে সামাজিক দায় মেটাতে চান কিন্তু তার বিনিময়ে কোনো বেতন বা সম্মানি চান না। কেউ কেউ এরকম থাকতে পারেন যদি তিনি আর্থিকভাবে স্বচ্ছল হন। যদি সাংবাদিকতা করে তার সংসার চালাতে না হয়।
যদি কারো বিকল্প আয়ের পথ না থাকে, যদি সাংবাদিকতা করেই তাকে চলতে হয়, তাহলে তাকে বেতন দিতে হবে। না দিলে তিনি সংশ্লিষ্ট সংবাদমাধ্যমের পরিচয় ব্যবহার করে অবৈধ পথে, অসৎ উপায়ে পয়সা উপার্জনের চেষ্টা করবেন। এটা শুধু স্থানীয় পর্যায়ের ব্যাপার নয়, সংবাদমাধ্যমের মূল অফিসের কর্মীদের বেলায়ও একই কথা প্রযোজ্য। যদি তাদের ঠিকমতো বেতন না হয়, সংসার চালানোর মতো আর্থিক সঙ্গতি না থাকে, তাহলে হয় তাকে বিকল্প কোনো আয়ের পথ খুঁজতে হবে, না হয় অসৎ পথে পা বাড়াতে হবে।
একজন ব্যবসায়ী বা সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মীর অসৎ হওয়া আর একজন সাংবাদিকে অসৎ হওয়ার মধ্যে পার্থক্য অনেক। মানুষ মনে করে ও বিশ্বাস করে যে, যে কোনো সমস্যা নিয়ে তার কাছে গেলে তিনি সমাধান করতে পারুন বা না পারুন, অন্তত সমাধানের একটা উপায় বলে দেবেন। এই যে বিশ্বাস জনমনে তৈরি হয়েছে, সাংবাদিককে যদি এর মর্যাদা দিতে হয়, তাহলে আগে তার নিজেকে মর্যাদাবান করে গড়ে তুলতে হবে। যদি তাকে সারাক্ষণ নিজের রুটিরুজি নিয়ে চিন্তিত থাকতে হয়; নিজের চাকরির অনিশ্চয়তা নিয়ে সারাক্ষণ উদ্বিগ্ন থাকতে হয়— তাহলে তার পক্ষে ওই সামাজিক দায়িত্ব পালন তথা জনপ্রত্যাশা বাস্তবায়নে ভূমিকা রাখা কঠিন হয়ে পড়ে।
বাংলাদেশের সাংবাদিকদের প্রধান চ্যালেঞ্জ হচ্ছে এই পেশাগত অনিশ্চয়তা। যেকোনো সময় যেকোনো অজুহাতে কিংবা যেকোনো কারণে যে কারোর চাকরি চলে যেতে পারে। মূলধারার পত্রিকার সাংবাদিক হলে তিনি ওয়েজবোর্ডের নিয়ম অনুযায়ী কিছু আর্থিক সুবিধা পেলেও টেলিভিশনে কোনো ওয়েজবোর্ডও নেই। ফলে কেউ তাৎক্ষণিকভাবে চাকরিচ্যুত হলে কোনো আর্থিক সুবিধা নাও পেতে পারেন। না পেলে তিনি সর্বোচ্চ শ্রম আদালতে যেতে পারেন। যদিও অনেকেই এসব ঝামেলায় যেতে চান না।
সাংবাদিক কামাল আহমেদের নেতৃত্বে গঠিত গণমাধ্যম সংস্কার কমিশন সম্প্রতি যে প্রতিবেদন দিয়েছে, সেখানেও সাংবাদিকদের এই পেশাগত অনিশ্চয়তার বিষয়টি উঠে এসেছে। কমিশনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গণমাধ্যম সংস্কার কমিশনের মতবিনিময় সভাগুলোয় সাংবাদিক ও গণমাধ্যমকর্মীদের আর্থিক নিরাপত্তা একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে উঠে এসেছে। তাদের মতে, সাংবাদিকদের আর্থিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা না গেলে সৎ, সাহসী, বস্তুনিষ্ঠ ও স্বাধীন সাংবাদিকতা সম্ভব নয়। এছাড়া কমিশনের ওয়েবসাইটে দেশজুড়ে আসা পরামর্শগুলোতেও বিষয়টি বিশেষভাবে গুরুত্ব পেয়েছে।