আধুনিক ভূ-রাজনীতির প্রেক্ষাপটে বাণিজ্যপথ মানেই আর শুধু পণ্য পরিবহনের উপায় নয় বরং এটি এখন একেকটি রাষ্ট্রের কৌশলগত অবস্থান, আধিপত্য ও আন্তর্জাতিক প্রভাব বিস্তারের হাতিয়ার। চীন যখন তার বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের (BRI) মাধ্যমে বিশ্বের নানান অঞ্চলে প্রভাব বিস্তার করছে, তখন ভারত সিল্ক রোডের পাল্টা হিসেবেই তুলে ধরছে ‘কটন রোড’র নতুন দর্শন। এই নতুন রোড কৌশলের পেছনে শুধু ঐতিহাসিক স্মৃতি নয়, রয়েছে আধুনিক অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক অঙ্ক। এই পটভূমিতে বাংলাদেশের মতো গুরুত্বপূর্ণ ভারত মহাসাগরীয় দেশের কৌশলগত অবস্থান কী হওয়া উচিত, সেটি এখন এক জরুরি প্রশ্ন।
ভারত বনাম চীন: বাণিজ্যপথে আধিপত্যের লড়াই
চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং ২০১৩ সালে সিল্ক রোড পুনরুজ্জীবনের ঘোষণা দেন। যার মাধ্যমে এশিয়া, ইউরোপ এবং আফ্রিকাকে অবকাঠামো উন্নয়নের মাধ্যমে যুক্ত করার পরিকল্পনা নেয় বেইজিং। বাস্তবে এটি হচ্ছে চীনের এককেন্দ্রিক বাণিজ্যিক একাধিপত্য কায়েমের কৌশল। বহু উন্নয়নশীল দেশ এ প্রকল্পে যুক্ত হয়ে রাজনৈতিকভাবে চীনের প্রভাব বলয়ে ঢুকে পড়েছে। আবার অনেকে ঋণের জালে জর্জরিত হয়ে পড়েছে। পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা ও আফ্রিকার কয়েকটি দেশের এর জ্বলন্ত উদাহরণ। এই প্রেক্ষাপটের বিপরীতে ভারত ‘কটন রোড’ নামে যে কৌশলগত পরিকল্পনা নিয়েছে, সেটি একটি বিকল্প বাণিজ্যপথ হিসেবে উদীয়মান। ২০১৫ সালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর নির্দেশনায় প্রাচীন ভারতীয় বাণিজ্যপথগুলো পুনরুজ্জীবনের পরিকল্পনায় সূচনা হয়। যার কেন্দ্রবিন্দু ছিল ভারতীয় তুলার ইতিহাস এবং ভূমধ্যসাগরীয় দেশগুলোর সঙ্গে তাদের ঐতিহাসিক সম্পর্ক।
কটন রোড: শুধু ইতিহাস নয়, ভবিষ্যতেরও পথ
কটন রোড মূলত প্রাচীন ভারতের তুলা রপ্তানির ঐতিহাসিক পথ, যা ভারতকে মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরোপের সঙ্গে যুক্ত করেছিল। ভারতীয় তুলা ছিল সেই সময়ে বিশ্ববাজারের অন্যতম উচ্চমানের পণ্য। আধুনিক যুগে এই পথ আবারও তুলে ধরছে ভারত। তবে এবার তা একটি কৌশলগত এবং অর্থনৈতিক শক্তি হিসেবে।
২০২৩ সালের জি-২০ সম্মেলনে ‘ইন্ডিয়া-মিডল ইস্ট-ইউরোপ ইকোনমিক করিডোর’ (IMEC) নামক প্রকল্পে কটন রোডের রূপরেখা তুলে ধরেছে নয়াদিল্লি। এতে ইতালি, সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, ইরান ও ফ্রান্সসহ নানা দেশ সংযুক্ত হয়েছিল। চীন যখন পাকিস্তানের গোয়াদার এবং শ্রীলঙ্কার হাম্বানটোটা বন্দরকে ব্যবহার করছে, ভারত তখন ইরানের চাবাহার বন্দর এবং ভূমধ্যসাগরীয় রুটের উপর জোর দিচ্ছে।
বাংলাদেশের ভূ-কৌশলগত বাস্তবতা
বাংলাদেশ ভারতের প্রতিবেশী এবং বঙ্গোপসাগরীয় অঞ্চলের গুরুত্বপূর্ণ একটি রাষ্ট্র। একইসাথে বাংলাদেশ চীনের BRI প্রকল্পের অংশ। পদ্মা সেতু, কর্ণফুলী টানেল এবং মেট্রোরেলসহ বহু অবকাঠামো প্রকল্পে চীনের সম্পৃক্ততা আমাদের স্পষ্ট করে দেয় যে, চীনের অর্থনৈতিক উপস্থিতি বাংলাদেশে গভীর। কিন্তু এরই ফাঁকে ভারতীয় কটন রোডের মত বিকল্প রুট উদ্ভূত হওয়ায় বাংলাদেশের জন্য এখন সুযোগ এসেছে আরও ভারসাম্যপূর্ণ কৌশল নেয়ার।
বাংলাদেশ এমন একটি কৌশল নিতে পারে, যেখানে চীন ও ভারতের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করে দুই দেশের সঙ্গেই সহযোগিতা বজায় রাখা সম্ভব। যেমন, ভারত যদি কটন রোডে চট্টগ্রাম বা মংলা বন্দরকে ব্যবহার করতে চায়, তা হলে আমরা সেই সুবিধা দিতে পারি। এর মাধ্যমে আমরাও ভারতের মাধ্যমে মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরোপে নতুন রপ্তানি বাজার খুঁজে পেতে পারি।
কেন কটন রোডে আগ্রহী হওয়া উচিত?
বাংলাদেশের মোট রপ্তানির সিংহভাগ এখনো ইউরোপ-আমেরিকার দিকেই, এবং আমাদের তৈরি পোশাক শিল্প তার প্রধান চালিকা শক্তি। কটন রোড আমাদের এই রপ্তানি আরও বহুমুখীকরণে সহায়তা করতে পারে। ভারত যদি মধ্যপ্রাচ্য এবং ইউরোপের সঙ্গে সরাসরি সমুদ্রপথে বাণিজ্যিক করিডোর গড়ে তোলে, বাংলাদেশের জন্য সেই পথে যুক্ত হয়ে লাভবান হওয়ার অপার সুযোগ তৈরি হবে। বিশেষ করে বাংলাদেশের চট্টগ্রাম ও পায়রা বন্দর, কটন রোডের একটি গুরুত্বপূর্ণ সংযোগস্থলে পরিণত হতে পারে।