
একটি নতুন ভোরের সন্ধানে: বাংলাদেশের পথ কি সত্যিই পাল্টেছে?
অন্তর্বর্তী সরকারের এক বছর পূর্তি উপলক্ষে ঢাকার কেন্দ্রস্থলে হাজারো মানুষের সমাবেশকে মনে হচ্ছিল আবেগ ও আশার এক বিস্ফোরণ। মুষলধারার বৃষ্টিতে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাদের সঙ্গে নিয়ে মঞ্চে দাঁড়িয়ে প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের ‘নতুন বাংলাদেশ’ গড়ার প্রতিশ্রুতি দেওয়া মুহূর্তটি অনেকে ‘দ্বিতীয় স্বাধীনতার’ সূচনা হিসেবে কল্পনা করেছেন। দেশের নানা প্রান্তে কনসার্ট, পতাকা মিছিল, দোয়া মাহফিল—সব মিলিয়ে উৎসবমুখর সেই আবহ মানুষকে ক্ষণিকের জন্য এক ভিন্ন বাস্তবতার স্বাদ দিয়ে গেল। কিন্তু এই উচ্ছ্বাসের আড়ালে কি লুকিয়ে ছিল না সেই পুরোনো সমস্যাগুলো, যেগুলো ক্ষমতার পালাবদলেও সহজে মুছে যায় না? এই আনন্দমুখর দৃশ্য কি আসলেই বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতির পুরো চিত্র?
বাস্তবতা হলো, গত বছর অগাস্টে ক্ষমতা পরিবর্তন হলেও দেশের মৌলিক চ্যালেঞ্জগুলো এখনও অপরিবর্তিত রয়ে গেছে। গত এক বছরে গণপিটুনিতে হত্যা, মব সহিংসতা, প্রতিশোধমূলক হামলা এবং ধর্মীয় উগ্রবাদের পুনরুত্থান গণতন্ত্রের পথে একটি বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। একটি স্বৈরতান্ত্রিক সরকারকে ক্ষমতা থেকে সরানো হয়েছে, কিন্তু স্বৈরতান্ত্রিক চর্চাগুলো পুরোপুরি নির্মূল হয়নি।
নতুন সরকার শপথ নেওয়ার পর একটি বড় প্রত্যাশা ছিল যে, বিচার ব্যবস্থা রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত হবে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, বিচারবহির্ভূত হত্যা, হেফাজতে মৃত্যু এবং রাজনৈতিক কারণে আটক রাখার মতো ঘটনাগুলো সম্পূর্ণ বন্ধ হয়নি। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)-এর সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুযায়ী, জনতার সহিংসতা বেড়েছে এবং বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড অব্যাহত আছে। এই ঘটনাগুলো দেখিয়ে দেয় যে, একটি সরকার সরিয়ে দিলেই দেশের গভীর শিকড়ে থাকা সমস্যাগুলো রাতারাতি দূর হয় না। প্রশাসনিক এবং বিচারিক কাঠামোতে সংস্কার না হলে, স্বৈরাচারী চর্চাগুলো থেকে বের হয়ে আসা কঠিন।
খুনের অভিযোগে মাসের পর মাস কারাগারে আটকে রাখা হয়েছে বহুজনকে। বহু ক্ষেত্রে মনে হয়েছে, অপরাধের প্রমাণের চেয়ে রাজনৈতিক পরিচয়ই তাদের আটক রাখার মূল কারণ। এটি শুধু একটি গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘন নয়, বরং গণতন্ত্রের মৌলিক নীতিকেই প্রশ্নবিদ্ধ করে। যদি নতুন সরকারও আগের শাসনের মতো একই দমনমূলক কৌশল বজায় রাখে, তবে ‘নতুন বাংলাদেশ’ গড়ার অঙ্গীকার শেষ পর্যন্ত ফাঁপা বুলি হয়ে থেকে যাবে।
অন্তর্বর্তী সরকারের গঠিত নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশন যখন লিঙ্গসমতা, বিবাহিত ধর্ষণকে অপরাধ ঘোষণা এবং যৌনকর্মীদের অধিকার রক্ষার মতো প্রগতিশীল সুপারিশগুলো করেছিল, তখন হাজার হাজার কট্টরপন্থী মানুষ এর বিরুদ্ধে রাস্তায় নেমে আসে। বিরোধিতাকারীরা এই সুপারিশগুলোকে ‘ইসলামবিরোধী’ আখ্যা দেয় এবং পুরুষ ও নারীর মধ্যে সমতা প্রতিষ্ঠার ধারণাকে সরাসরি চ্যালেঞ্জ করে। দুঃখজনক সত্যি হলো এরপর ওই সুপারিশগুলো নিয়ে আর কোনো আলোচনা হয়নি।
এই ঘটনাটি কেবল একটি একক উদাহরণ নয় বরং একটি বৃহত্তর প্রবণতার প্রতিফলন। হাসিনার আমলে চাপের মুখে থাকা কট্টরপন্থীরা এখন অনেক বেশি সাহসী এবং প্রভাবশালী হয়ে উঠেছে। তারা কিছু এলাকায় নারীদের ফুটবল খেলার বিরোধিতা করেছে, নারী তারকাদের বাণিজ্যিক অনুষ্ঠানে অংশ নেওয়া বন্ধ করতে বলেছে এবং পোশাকের কারণে জনসমক্ষে নারীদের হয়রানি করেছে। এসব ঘটনা আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে, বাংলাদেশের সমাজে নারীবিদ্বেষ বাড়ছে এবং পুরুষের আধিপত্য নিরঙ্কুশ রয়ে গেছে।
গত এক বছরে অসংখ্য মাজার ভাঙা হয়েছে। একটি গণতান্ত্রিক এবং বহুত্ববাদী সমাজে এই ধরনের কর্মকাণ্ডের কোনো স্থান নেই। নতুন সরকার যদি এই চ্যালেঞ্জগুলোকে গুরুত্ব সহকারে মোকাবিলা করতে না পারে, তাহলে দেশের সামাজিক কাঠামোতে আরও বিভাজন সৃষ্টি হবে।
অর্থনৈতিক দিক থেকে কিছু ইতিবাচক পরিবর্তন দৃশ্যমান হয়েছে। বাংলাদেশ তার ঋণ শোধ করেছে, খাদ্যের দাম মোটামুটি স্থিতিশীল রেখেছে এবং রেমিটেন্স ও আন্তর্জাতিক ঋণের কারণে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৩০ বিলিয়ন ডলারে বজায় রেখেছে। রপ্তানিও স্থিতিশীল আছে। এই অর্থনৈতিক সূচকগুলো দেখে মনে হতে পারে যে, দেশ সঠিক পথেই আছে। কিন্তু এই অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা দেশের সামাজিক ও রাজনৈতিক অস্থিরতাকে আড়াল করতে পারছে না।
ব্যাংক খাতে কিছু দৃশ্যমান পরিবর্তন হলেও, দুর্নীতির গভীরতা এবং রাজনৈতিক প্রভাব এখনও বড় একটি সমস্যা। বিগত সরকারের আমলে বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা লোপাট হয়েছে, যার সঠিক তদন্ত হয়নি। নতুন সরকার এই দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেবে বলে আশা করা হয়েছিল, কিন্তু এই বিষয়ে এখন পর্যন্ত বড় কোনো অগ্রগতি দেখা যায়নি।
দেশে অবৈধ অস্ত্রের ঝনঝনানি থামেনি এবং লুট হওয়া অস্ত্রও উদ্ধার করা যায়নি। এই পরিস্থিতি আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটাচ্ছে এবং সাধারণ মানুষের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ তৈরি করছে। যদিও সরকার আগামী ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচনের কথা বলছে, কিন্তু এই নির্বাচন কীভাবে অনুষ্ঠিত হবে এবং এর ফল কতটা নিরপেক্ষ হবে, তা নিয়ে জনমনে আস্থা সৃষ্টি হয়নি।
- ট্যাগ:
- মতামত
- বর্ষপূর্তি
- অন্তর্বর্তী সরকার