
আমরা কি অসহিষ্ণু হয়ে পড়ছি?
বিশ্বায়নের এই যুগে আমরা ক্রমেই যোগাযোগের নেটওয়ার্কে আবদ্ধ হচ্ছি। ভৌগোলিক দূরত্ব সঙ্কুচিত হচ্ছে। সংস্কৃতি, ভাষা ও চিন্তাধারার বিনিময় বেড়ে চলেছে। তবুও এক অদ্ভুত বৈপরীত্য চোখে পড়ে-প্রযুক্তি ও জ্ঞানের অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে আমাদের সমাজে অসহিষ্ণুতার প্রকাশও যেন বেড়ে যাচ্ছে।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ঘৃণাবাচক মন্তব্য, রাজনৈতিক মতভেদে শত্রুতা, ধর্মীয় ও জাতিগত পরিচয়ে বৈষম্য-এসবই প্রশ্ন তোলে, আমরা কি জাতিগতভাবে অসহিষ্ণু হয়ে পড়ছি?
সহিষ্ণুতা (Tolerance) শুধু নৈতিক গুণ নয়, এটি একটি সভ্য সমাজের টিকে থাকার শর্ত। ফরাসি দার্শনিক ভলতেয়ার (Voltaire) একবার বলেছিলেন, ‘I disapprove of what you say, but I will defend to the death your right to say it.’
অর্থাৎ মতের ভিন্নতা থাকা সত্ত্বেও অন্যের মত প্রকাশের অধিকারকে রক্ষা করা। জাতিগত, ধর্মীয়, রাজনৈতিক বা সাংস্কৃতিক পার্থক্য সত্ত্বেও সহিষ্ণু আচরণই একটি জাতিকে সভ্যতার উচ্চ শিখরে পৌঁছে দেয়।
ব্রিটিশ দার্শনিক জন স্টুয়ার্ট মিল (John Stuart Mill) তাঁর বই On Liberty (1859)-এ বলেছেন, ‘Genuine tolerance is not about indifference; it is about valuing diversity as a source of societal strength.’
অর্থাৎ, সহিষ্ণুতা মানে উদাসীন থাকা নয়, বরং বৈচিত্র্যকে সমাজের শক্তি হিসেবে মূল্যায়ন করা। এমনকি মহাত্মা গান্ধী উল্লেখ করেন, ‘Our ability to reach unity in diversity will be the beauty and the test of our civilization.’
এখানে তিনি বলেন, বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্য প্রতিষ্ঠাই সভ্যতার সৌন্দর্য ও পরীক্ষার আসল মাপকাঠি। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে নানা জরিপ, যেমন Pew Research Center বা World Values Survey, দেখাচ্ছে যে অনেক দেশে জাতিগত, ধর্মীয় ও রাজনৈতিক বিভাজন গভীর হচ্ছে।
এর অন্যতম কারণ হলো ভয়ের রাজনীতি, তথ্যবিকৃতি এবং অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা। যখন একটি জাতি নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে, তখন তারা ভিন্ন পরিচয়ধারীদের প্রতি সন্দেহপ্রবণ হয়ে ওঠে। নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন (Amartya Sen) তার Identity and Violence (2006)-এ যুক্তি দেন, “A person’s identity is never singular; intolerance grows when we reduce people to only one dimension of who they are.” অর্থাৎ মানুষকে কেবল এক পরিচয়ে সীমাবদ্ধ করে দেখার চেষ্টা থেকেই অসহিষ্ণুতা জন্মায়।
এই প্রসঙ্গে রাজনৈতিক দার্শনিক আইজাহ বার্লিন (Isaiah Berlin) তার Value Pluralism তত্ত্বে বলেন, “In a world of different values, the task is not to force them into one mold but to create a space where they can coexist.” অর্থাৎ, ভিন্ন মূল্যবোধকে এক ছাঁচে ফেলতে গেলে সংঘাত বাড়ে বরং তাদের সহাবস্থানের জন্য জায়গা তৈরি করাই আসল কাজ।
আমরা যদি উন্নত বিশ্বের দিকে তাকাই, দেখতে পাবো-সহিষ্ণুতা রাতারাতি জন্মায়নি, বরং এটি দীর্ঘ রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক চর্চার ফল। উদাহরণস্বরূপ আমরা প্রথমেই কানাডার কথা বলতে পারি। কানাডাকে বলা হয় মাল্টিকালচারালিজমের রাজধানী।
এখানে সরকারি নীতি অনুযায়ী অভিবাসীদের সাংস্কৃতিক পরিচয় সংরক্ষণের পাশাপাশি মূলধারার সমাজে অন্তর্ভুক্তির সুযোগ দেওয়া হয়। শিক্ষা ব্যবস্থায় বহুসংস্কৃতি শিক্ষা বাধ্যতামূলক। ছোটবেলা থেকেই শিশুদের শেখানো হয় কীভাবে ভিন্ন মতকে সম্মান করতে হয়।
এরপর আমরা নেদারল্যান্ডসের উদাহরণ তুলতে পারি। নেদারল্যান্ডস বহু দশক ধরে liberal tolerance-এর উদাহরণ। ধর্মীয় স্বাধীনতা, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা এবং সমলিঙ্গ বিবাহসহ নানা উদারনীতিতে তারা বিশ্বে শীর্ষে। এখানে সরকার কেবল আইন প্রণয়নেই নয় বরং জনমত গঠনে শিক্ষা, গণমাধ্যম ও নাগরিক অংশগ্রহণকে কাজে লাগায়।
- ট্যাগ:
- মতামত
- অসহিষ্ণুতা