সংকটময় বিশ্ব: সংঘাত, নাজুকতা ও অস্থিতিশীলতা
বর্তমান সময়ে আমরা একটি অসম, অস্থিতিশীল ও অবজায়ক্ষম বিশ্বে বসবাস করি। এটি ছোট্ট একটি বক্তব্য, কিন্তু এর গভীরতা অনেক। প্রথমত, বক্তব্যটি মোটাদাগে বর্তমান বিশ্বের নিরেট বাস্তবতাটিকেই তুলে ধরে। দীর্ঘদিন ধরে বিশ্ব শুধু একটি সংকটের মোকাবিলা করছে না, বরং একই সঙ্গে একাধিক সংকটের মুখোমুখি হচ্ছে। এই সংকটগুলো একে অপরকে আরও জোরদার করছে। দ্বিতীয়ত, অসমতা, অস্থিতিশীলতা ও অবজায়ক্ষমতার মধ্যে একটি পারস্পরিক যোগাযোগ আছে। যেমন গেড়ে বসা অসমতা একটি সমাজকে অস্থিতিশীল করে ফেলতে পারে। আবার সামাজিক অস্থিতিশীলতার ফলে সমাজ বজায়ক্ষম থাকার শক্তি হারিয়ে ফেলতে পারে। তৃতীয়ত, এই তিনটি ধারণার প্রতিটির একটি বিশ্লেষণাত্মক ব্যবচ্ছেদ দরকার। যেমন অসমতা নানান মাত্রিকতায় কাজ করে—অর্থনৈতিক অসমতা, সামাজিক অসমতা, রাজনৈতিক অসমতা, সাংস্কৃতিক অসমতা। আবার অসমতা শুধু আয় বা সম্পদের মতো ফলাফলের ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ নয়; অসমতা স্বাস্থ্য, শিক্ষার মতো মৌলিক সামাজিক সেবার সুযোগের ক্ষেত্রেও থাকতে পারে। তেমনিভাবে, অস্থিতিশীলতার উৎস ঘরে-বাইরে যুদ্ধ বা সংঘাত হতে পারে ঠিকই, কিন্তু অর্থনৈতিক মন্দা বা তার অর্থনৈতিক কাঠামো ভেঙে পড়ার ফলেও একটি দেশে অস্থিতিশীলতার আত্মপ্রকাশ ঘটতে পারে। চতুর্থত, বজায়ক্ষমতাকে শুধু পরিবেশের নিরিখে দেখা ভুল, রাজনৈতিক বজায়ক্ষমতা, অর্থনৈতিক বজায়ক্ষমতা, সামাজিক বজায়ক্ষমতাও সমান গুরুত্বপূর্ণ।
বৈশ্বিক আয় এবং সম্পদের দিকে যদি চোখ ফেরানো যায়, তাহলে দেখা যাবে যে আমাদের এই পৃথিবী অসম্ভব রকমের অসম। আয়ের ক্ষেত্রে বৈশ্বিক আয়ের ৫৩ শতাংশই ভোগ করে বিশ্বের একেবার উচ্চতম ১০ শতাংশ জনগোষ্ঠী। বৈশ্বিক আয়ের মাত্র ৮ শতাংশ যায় নিচের দিকের ৫০ শতাংশ মানুষের কাছে। সম্পদের ক্ষেত্রে এই ব্যবধান আরও ভয়াবহ। বৈশ্বিক সম্পদের ৭৪ ভাগ ভোগ করে বিশ্বের উচ্চতম ১০ শতাংশ মানুষ, আর বিশ্বের নিচের দিকের অর্ধেক মানুষ বৈশ্বিক মোট সম্পদের মাত্র ২ শতাংশের মালিক। এমনতর বৈষম্যের প্রবণতা বিশ্বের নানান অঞ্চল ও দেশেও পরিলক্ষিত হয়। এবং এসবের সুদূরপ্রসারী অভিঘাত রয়েছে।
প্রথমত, এ-জাতীয় বৈষম্য একদিকে যেমন উৎপাদনক্ষম সম্পদ, মৌলিক সামাজিক স্বাস্থ্যসেবায় অসম অভিগমনকে প্রতিফলিত করে; অন্যদিকে, এই বাস্তবতা থেকে আমরা বুঝতে পারি যে বৈশ্বিক সম্পদ ও সেবা একটি ক্ষুদ্র শ্রেণির কুক্ষিগত। এর মানে হচ্ছে যে আমাদের পৃথিবীতে একটি বিশাল অর্থনৈতিক বিভাজন এবং সামাজিক স্তরবিন্যাস বিদ্যমান। দ্বিতীয়ত, দীর্ঘমেয়াদি প্রবহমান বৈষম্য সাধারণ মানুষের মনে একটি গভীর নৈরাশ্য ও হতাশার জন্ম দেয়। যেসব মানুষ বৈষম্যের শিকার হয়, তারা স্বাভাবিকভাবেই অসমতাকে অন্যায্য বলে ভাবে। সেখান থেকেই ক্ষোভ এবং নৈরাশ্যের জন্ম হয়। চরম অবস্থায় অসমতা সামাজিক এবং রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার জন্ম দেয়। তৃতীয়ত অসমতা সামাজিক বন্ধন ও সৌহার্দ্যকে দুর্বল করে ফেলে। এর কারণে দেশজ এবং বৈশ্বিকভাবেও এক ধরনের ভঙ্গুরতা এবং নাজুকতার জন্ম হয়। এভাবেই অসমতা এবং বৈষম্য সমাজের রাজনৈতিক এবং আর্থসামাজিক বজায়ক্ষমতাকে নষ্ট করে।
উপসম্পাদকীয়
সংকটময় বিশ্ব: সংঘাত, নাজুকতা ও অস্থিতিশীলতা
বিশ্বের প্রান্তিক মানুষেরাই পরিবেশগত প্রভাবের সিংহভাগ বহন করে, কারণ তারাই পরিবেশগত অবক্ষয়ের সবচেয়ে বড় শিকার। অধিকন্তু, জলবায়ু পরিবর্তন দরিদ্র দেশগুলোরই বেশি ক্ষতি করে। এবং পরিহাসের বিষয় হচ্ছে যে যারা জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য সবচেয়ে কম দায়ী, তারাই এ পরিবর্তনে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
সেলিম জাহান
প্রকাশ : ২৬ নভেম্বর ২০২৫, ০৭: ৩৩
বৈশ্বিক অস্থিতিশীলতার একটি অন্যতম কারণ হচ্ছে যুদ্ধ ও সংঘাত। ছবি: সংগৃহীত
বর্তমান সময়ে আমরা একটি অসম, অস্থিতিশীল ও অবজায়ক্ষম বিশ্বে বসবাস করি। এটি ছোট্ট একটি বক্তব্য, কিন্তু এর গভীরতা অনেক। প্রথমত, বক্তব্যটি মোটাদাগে বর্তমান বিশ্বের নিরেট বাস্তবতাটিকেই তুলে ধরে। দীর্ঘদিন ধরে বিশ্ব শুধু একটি সংকটের মোকাবিলা করছে না, বরং একই সঙ্গে একাধিক সংকটের মুখোমুখি হচ্ছে। এই সংকটগুলো একে অপরকে আরও জোরদার করছে। দ্বিতীয়ত, অসমতা, অস্থিতিশীলতা ও অবজায়ক্ষমতার মধ্যে একটি পারস্পরিক যোগাযোগ আছে। যেমন গেড়ে বসা অসমতা একটি সমাজকে অস্থিতিশীল করে ফেলতে পারে। আবার সামাজিক অস্থিতিশীলতার ফলে সমাজ বজায়ক্ষম থাকার শক্তি হারিয়ে ফেলতে পারে। তৃতীয়ত, এই তিনটি ধারণার প্রতিটির একটি বিশ্লেষণাত্মক ব্যবচ্ছেদ দরকার। যেমন অসমতা নানান মাত্রিকতায় কাজ করে—অর্থনৈতিক অসমতা, সামাজিক অসমতা, রাজনৈতিক অসমতা, সাংস্কৃতিক অসমতা। আবার অসমতা শুধু আয় বা সম্পদের মতো ফলাফলের ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ নয়; অসমতা স্বাস্থ্য, শিক্ষার মতো মৌলিক সামাজিক সেবার সুযোগের ক্ষেত্রেও থাকতে পারে। তেমনিভাবে, অস্থিতিশীলতার উৎস ঘরে-বাইরে যুদ্ধ বা সংঘাত হতে পারে ঠিকই, কিন্তু অর্থনৈতিক মন্দা বা তার অর্থনৈতিক কাঠামো ভেঙে পড়ার ফলেও একটি দেশে অস্থিতিশীলতার আত্মপ্রকাশ ঘটতে পারে। চতুর্থত, বজায়ক্ষমতাকে শুধু পরিবেশের নিরিখে দেখা ভুল, রাজনৈতিক বজায়ক্ষমতা, অর্থনৈতিক বজায়ক্ষমতা, সামাজিক বজায়ক্ষমতাও সমান গুরুত্বপূর্ণ।
বৈশ্বিক আয় এবং সম্পদের দিকে যদি চোখ ফেরানো যায়, তাহলে দেখা যাবে যে আমাদের এই পৃথিবী অসম্ভব রকমের অসম। আয়ের ক্ষেত্রে বৈশ্বিক আয়ের ৫৩ শতাংশই ভোগ করে বিশ্বের একেবার উচ্চতম ১০ শতাংশ জনগোষ্ঠী। বৈশ্বিক আয়ের মাত্র ৮ শতাংশ যায় নিচের দিকের ৫০ শতাংশ মানুষের কাছে। সম্পদের ক্ষেত্রে এই ব্যবধান আরও ভয়াবহ। বৈশ্বিক সম্পদের ৭৪ ভাগ ভোগ করে বিশ্বের উচ্চতম ১০ শতাংশ মানুষ, আর বিশ্বের নিচের দিকের অর্ধেক মানুষ বৈশ্বিক মোট সম্পদের মাত্র ২ শতাংশের মালিক। এমনতর বৈষম্যের প্রবণতা বিশ্বের নানান অঞ্চল ও দেশেও পরিলক্ষিত হয়। এবং এসবের সুদূরপ্রসারী অভিঘাত রয়েছে।
প্রথমত, এ-জাতীয় বৈষম্য একদিকে যেমন উৎপাদনক্ষম সম্পদ, মৌলিক সামাজিক স্বাস্থ্যসেবায় অসম অভিগমনকে প্রতিফলিত করে; অন্যদিকে, এই বাস্তবতা থেকে আমরা বুঝতে পারি যে বৈশ্বিক সম্পদ ও সেবা একটি ক্ষুদ্র শ্রেণির কুক্ষিগত। এর মানে হচ্ছে যে আমাদের পৃথিবীতে একটি বিশাল অর্থনৈতিক বিভাজন এবং সামাজিক স্তরবিন্যাস বিদ্যমান। দ্বিতীয়ত, দীর্ঘমেয়াদি প্রবহমান বৈষম্য সাধারণ মানুষের মনে একটি গভীর নৈরাশ্য ও হতাশার জন্ম দেয়। যেসব মানুষ বৈষম্যের শিকার হয়, তারা স্বাভাবিকভাবেই অসমতাকে অন্যায্য বলে ভাবে। সেখান থেকেই ক্ষোভ এবং নৈরাশ্যের জন্ম হয়। চরম অবস্থায় অসমতা সামাজিক এবং রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার জন্ম দেয়। তৃতীয়ত অসমতা সামাজিক বন্ধন ও সৌহার্দ্যকে দুর্বল করে ফেলে। এর কারণে দেশজ এবং বৈশ্বিকভাবেও এক ধরনের ভঙ্গুরতা এবং নাজুকতার জন্ম হয়। এভাবেই অসমতা এবং বৈষম্য সমাজের রাজনৈতিক এবং আর্থসামাজিক বজায়ক্ষমতাকে নষ্ট করে।
বৈশ্বিক অস্থিতিশীলতার একটি অন্যতম কারণ হচ্ছে যুদ্ধ ও সংঘাত। সংজ্ঞার এবং পরিবীক্ষণের পন্থার তারতম্যের কারণে বর্তমানে বিশ্বে ঠিক কতটা সংঘর্ষ বিদ্যমান, তার একটি নির্দিষ্ট সংখ্যা বের করা দুরূহ। তবে এ ব্যাপারে কিছু প্রাক্কলন আছে। বৈশ্বিক শান্তি সূচক বলে যে আজকের দুনিয়ায় মোট ৫৬টি রাষ্ট্রভিত্তিক সংঘাত রয়েছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে এই সংখ্যা সর্বোচ্চ। রেডক্রসের আন্তর্জাতিক পর্ষদের মতে, আন্তর্জাতিক সংঘাত উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পাওয়ায় বর্তমান বিশ্বে সশস্ত্র সংঘর্ষের সংখ্যা ১২০টি। পুরোপুরি যুদ্ধের আপাতন উপসাহারীয় অঞ্চলে সবচেয়ে বেশি। সব সংঘাতের সবচেয়ে বড় শিকার হয় সাধারণ মানুষ। গত বছর বিশ্বে ৬০ হাজার মানুষ যুদ্ধের কারণে প্রাণ দিয়েছে। এর একটি বড় অংশ, প্রায় এক-তৃতীয়াংশ, শুধু দখলকৃত ফিলিস্তিনেই আত্মাহুতি দিয়েছে।
অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতাও বৈশ্বিক অর্থনীতির একটি অন্যতম বৈশিষ্ট্য। এই অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতার আংশিক কারণ অবশ্যই বিশ্বের নানান জায়গার যুদ্ধ এবং সংঘাত, কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্বব্যাপী পাল্টা শুল্ক আরোপও এই অস্থিতিশীলতার জন্য অংশত দায়ী। বিশ্বের নানান দেশ আজ ‘অর্থনৈতিক জাতীয়তাবাদের’ দিকে ঝুঁকছে। এই দৃষ্টিভঙ্গির মূল কথা হচ্ছে, একপক্ষীয় ব্যবস্থা এবং একটি সীমাবদ্ধ অর্থনীতি এবং সেই সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় আদান-প্রদান, দ্বিপক্ষীয় আলাপ-আলোচনা—এই পর্যন্তই। বহুপক্ষীয় আলাপ-আলোচনা, কার্যক্রম এবং মুক্ত অর্থনীতির কথা এখানে অনুপস্থিত। এ-জাতীয় বিষয়গুলো বৈশ্বিক অর্থনীতিতে একটি অনিশ্চয়তার জন্ম দেয়, যার ফলে এই অর্থনৈতিক কাঠামো অস্থিতিশীল এবং নাজুক হয়ে পড়ে।
বৈশ্বিক অস্থিতিশীলতা, তা সে যুদ্ধবিগ্রহের কারণেই হোক, কিংবা অর্থনৈতিক ডামাডোলের কারণেই হোক, সমাজের সব মানুষের ওপরে একইভাবে প্রভাব ফেলে না। সমাজে যারা বিত্তশালী শ্রেণি হিসেবে চিহ্নিত, অস্থিতিশীলতার নেতিবাচক প্রভাব থেকে সুরক্ষার জন্য তাদের নানান পন্থা থাকে। অন্ততপক্ষে, সেসব প্রভাবকে ন্যূনতম পর্যায়ে রাখার ব্যবস্থা তাদের কাছে লভ্য। যেহেতু সমাজের দরিদ্র এবং প্রান্তিক মানুষের কাছে অস্থিতিশীলতা থেকে সুরক্ষার কোনো আর্থিক বা প্রাতিষ্ঠানিক রক্ষাকবচ নেই, তারাই যেকোনো অস্থিতিশীলতায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত। এটা এখন প্রমাণিত হয়েছে যে যুদ্ধ বা সংঘাতে সমাজের সব শ্রেণি সমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় না। যেমন যুদ্ধে নারী এবং শিশুরা যে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় তাই নয়, যুদ্ধের সময় তাদের ঢাল হিসেবে ব্যবহার করা হয়। তেমনিভাবে, অর্থনৈতিক মন্দার সময়ে যে দরিদ্র ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠী সবচেয়ে বেশি ক্ষতির শিকার হয়, তাই নয়; মন্দা শেষে পূর্বস্থানে ফেরাটা তাদের জন্য অত্যন্ত কষ্টকর হয়। অর্থনৈতিক কারণে উদ্ভূত অস্থিতিশীলতার নেতিবাচকের প্রভাবের ব্যাপ্তি এবং গভীরতা সমাজের নানান জনগোষ্ঠীর জন্য নানান রকমের।