বাংলাদেশ বাঁচবে কীভাবে
আমরা এখন সেই পরিবর্তনের দ্বারপ্রান্তে, যেখানে এআই শুধু উন্নয়ন নয়, মানবসভ্যতার ভবিষ্যৎ নতুনভাবে লিখে দেওয়ার শক্তি ধারণ করে। আজকের বাস্তবতা হলো, বিশ্বের অসংখ্য প্রতিষ্ঠান ইতিমধ্যেই কর্মী ছাঁটাই করছে এবং সেই কাজগুলো দ্রুত এআই দিয়ে প্রতিস্থাপন করছে। এই পরিবর্তন কাউকে অপেক্ষা করে না। তাই প্রশ্ন হলো, বাংলাদেশ কি এই রূপান্তরকে ভয় পাবে, নাকি বুঝেশুনে নতুন পথে হাঁটবে।
নিঃসন্দেহে বলা যায় বিশ্বে এআই সবচেয়ে বেশি জায়গা দখল করছে রুটিনভিত্তিক, পুনরাবৃত্তিমূলক এবং ডেটানির্ভর কাজগুলোতে। যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপে গত তিন বছরে যে চাকরিগুলো সবচেয়ে বেশি হারিয়েছে তার মধ্যে রয়েছে ডেটা এন্ট্রি, কাস্টমার কেয়ার, বেসিক কোডিং, কনটেন্ট রাইটিং, প্রশাসনিক এবং গ্রাফিকসের প্রাথমিক স্তরের কাজ। অভিজ্ঞতা দেখায় যে নিয়ম মেনে চলা এবং পুনরাবৃত্তিমূলক কাজ মেশিন মানুষের চেয়ে দ্রুত, সস্তা এবং অনেক কম ভুলের মাধ্যমে করতে পারে।
বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরাম (ডব্লিউইএফ) ফিউচার অব জবস রিপোর্ট ২০২৫-এ বলা হয়েছে, ২০৩০ সালের মধ্যে ৯২ মিলিয়ন চাকরি বিলুপ্ত হতে পারে, তবে ১৭০ মিলিয়ন নতুন চাকরি সৃষ্টি হবে। অর্থাৎ চাকরির সংখ্যা একই থাকবে, তবে ধরন বদলে যাবে। একইভাবে ম্যাককিনসে গ্লোবাল ইনস্টিটিউট (২০১৭) জানিয়েছে, আগামী দশকে ৪০০ থেকে ৮০০ মিলিয়ন কর্মীকে নতুন দক্ষতা অর্জন করে পুনরায় নিজেদের প্রস্তুত করতে হবে। এই ডেটাগুলো প্রমাণ করে যে পরিবর্তন আর ভবিষ্যতের কোনো ধারণা নয়, এটি এখনই ঘটছে। এখানেই বাংলাদেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ বার্তা রয়েছে। আমার পর্যবেক্ষণে বিশ্বে এআই সবচেয়ে দ্রুত প্রতিস্থাপন করছে ডেটা এন্ট্রি, কলসেন্টার, টিকিটিং, ব্যাংক টেলার, সাধারণ অ্যাকাউন্টিং, লিগ্যাল রিসার্চ, সাধারণ কনটেন্ট তৈরি, ক্যাশিয়ার, প্রাথমিক গ্রাফিক ডিজাইন এবং পণ্যের বর্ণনা লেখার কাজ। যেহেতু বাংলাদেশের কর্মসংস্থানের বড় অংশ এখনো এসব কাজের ওপর নির্ভরশীল, তাই এখানেই তৈরি হচ্ছে সবচেয়ে বড় ঝুঁকি।
অন্যদিকে যেসব চাকরি বাড়ছে সেগুলো এআই ব্যবহারের ফলে তৈরি হওয়া নতুন প্রয়োজন এবং মানবকেন্দ্রিক দক্ষতার ওপর দাঁড়ানো। অভিজ্ঞতা বলছে মানবিক যোগাযোগ, বিশ্লেষণ, সৃজনশীলতা এবং কৌশলগত চিন্তার জায়গায় মেশিন মানুষের বিকল্প হতে পারে না। তাই বিশ্বে দ্রুত বাড়ছে এআই ট্রেনিং, সাইবার সিকিউরিটি, ডেটা সায়েন্স, মেশিন লার্নিং ইঞ্জিনিয়ারিং, সফটওয়্যার আর্কিটেকচার, উন্নত ডিজাইন, চিকিৎসা, কাউন্সেলিং, গবেষণা, শিক্ষা এবং কনসালটিংয়ের মতো পেশা। যদিও এসব দক্ষতা অর্জন কঠিন, কিন্তু একবার দক্ষ হলে চাকরি হারানোর ভয় থাকে না।
বাংলাদেশের বাস্তবতায় দেখা যায়, আমাদের কর্মশক্তির একটি বড় অংশ এখনো ম্যানুয়াল অথবা প্রাথমিক ডিজিটাল কাজে যুক্ত। ফলে এআই প্রথম আঘাত করবে এখানেই। গ্রাফিকসের প্রাথমিক কাজ, সোশ্যাল মিডিয়া ম্যানেজমেন্ট, বেসিক লেখালেখি এবং সাধারণ সফটওয়্যার টেস্টিং। এসব কাজ আগামী কয়েক বছরের মধ্যেই বিশ্ববাজারে গুরুত্ব হারাবে। অথচ বাংলাদেশের তরুণদের বড় অংশ ঠিক এই কাজগুলোর ওপর নির্ভরশীল। তাই প্রয়োজনীয় দক্ষতা অর্জন ছাড়া প্রতিযোগিতায় থাকা কঠিন হয়ে পড়বে।
অন্যদিকে সুযোগও কম নয়। বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্ম সংখ্যায় বড়, প্রযুক্তি শেখার গতি দ্রুত এবং বৈশ্বিক বাজারে কাজ করার ইচ্ছা প্রবল। ফলে আগামী দশকে আমরা চাইলে ডেটা সায়েন্স, এআই ট্রেনিং, মেশিন লার্নিং অপারেশন, সাইবার সিকিউরিটি এবং ডিজিটাল বিজনেসের বড় সক্ষম শ্রমশক্তি হয়ে উঠতে পারি। কারণ, যত বেশি এআই তৈরি হবে তত বেশি প্রয়োজন হবে দক্ষ মানুষের, যারা এই প্রযুক্তিকে পরিচালনা করবে।