
বিজেপির অহমিকায় ঘা দিল জেএনইউ
সংবাদমাধ্যম বা রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের এখন ব্যস্ততার শেষ নেই। ভারতজুড়ে উত্তেজনা চরমে। পহেলগাঁও-কাণ্ডের পর একের পর ঘটনা যেভাবে প্রতিদিন চাঞ্চল্য ছড়াচ্ছে, তাতে লেখার বিষয়ের কোনো অভাব হওয়ার কথা নয়। তবে আমার কাছে এ মুহূর্তে আকর্ষণীয় খবর নিঃসন্দেহে দিল্লির জওহরলাল নেহেরু ইউনিভার্সিটি, সংক্ষেপে জেএনইউ-এ বামপন্থি রাজনীতির বিজয়। যদিও পহেলগাঁও হত্যাকাণ্ড-পরবর্তী ভারতের ছবি অনেক বেশি বড় মাপের। বলা যেতে পারে, উগ্র জাতীয়তাবাদ যেভাবে মাথা তুলেছে, তা ১৯৬২-এর চীন বা ১৯৬৫ সালের পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধের চেয়েও ব্যাপক ও উদ্বেগজনক। কোনো কোনো সময় মনে হচ্ছে, এ যেন ১৯৪৭ সালের আগের অখণ্ড ভারত। সাম্প্রদায়িক বিষে জর্জরিত পশ্চিমবঙ্গ, বিহার, মধ্যপ্রদেশ, উত্তরপ্রদেশের নানা জায়গা থেকে যেভাবে অশান্তির খবর আসছে, তাতে মস্তিষ্কের সুস্থতা ঠিক রাখা দুষ্কর। হাওয়ার গতিতে গুজব ছড়িয়ে পড়ছে। এ এক অন্ধকার সময়। কত চেনা মানুষ মুহূর্তে অচেনা হয়ে যাচ্ছেন। সম্পর্ক নষ্ট হচ্ছে ঘনিষ্ঠজনের সঙ্গে। চোখ বন্ধ করলেও যেন শোনা যাচ্ছে অস্ত্রের ঝনঝনানি। অদৃশ্য তরবারি মানুষে মানুষে ভেদাভেদ নির্মাণে অতি সক্রিয়। সেই অবস্থায় দাঁড়িয়ে জেএনইউর কতগুলো ছেলেমেয়ে শাসকদের যাবতীয় লাল চোখ, হুমকি, সন্ত্রাসকে হারিয়ে জিতে গেল। এ বিজয় নিছক কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদের নির্বাচনি সাফল্য নয়। এ জয় দেশের শাসকদের তৈরি উগ্র জাতীয়তাবাদী রাজনীতির বিরুদ্ধে বহুত্ববাদী, ধর্মনিরপেক্ষ ভারতের জয়।
নরেন্দ্র মোদি ক্ষমতায় আসার পর থেকেই জেএনইউ বিজেপি ও সংঘ পরিবার তাদের চক্ষুশূল এ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটিকে ছলে-বলে-কৌশলে ধ্বংস করতে ব্যাগ্র। বিজেপি লালিত সিনেমা পরিচালকদের ফিল্ম থেকে শুরু করে এদেশের গোদী মিডিয়া সর্বত্রই জেএনইউ হয়ে উঠেছে সিম্বল অব অ্যান্টি ন্যাশনাল। দেশদ্রোহিতার প্রতীক। কমিউনিস্টদের আখড়া। ফলে ২০১৬ সাল থেকে শাসক দল ও তার অনুগতদের হামলা নেমে এসেছে দেশের, বলা ভালো, পৃথিবীর অন্যতম এ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ওপর। দেশে দেশে ফ্যাসিবাদের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, প্রথমেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ধ্বংস করা। কথায় আছে, মাছের মতোই সমাজের পচন ধরে মস্তিষ্ক থেকে। ভারতের বহুত্ববাদী, ধর্মনিরপেক্ষ যে ধারা বহুকাল ধরে বহমান, তাকে আটকাতে না পারলে এদেশে উগ্র মনুবাদী দর্শনের বিকাশ অসম্ভব, তা বুঝতে দেরি হয়নি বিজেপির থিঙ্ক ট্যাঙ্ক আরএসএসের। তাই নানাভাবে জেএনইউর ভাবমূর্তি নষ্ট করতে ক্ষমতা দখলের পর থেকে সচেষ্ট দক্ষিণপন্থি রাজনীতি। শাসক অনুগত উপাচার্য, অধ্যাপক নিয়োগ করা থেকে পিএইচডি স্কলারশিপ দলীয় কর্মীদের মধ্যে বিতরণ-যাবতীয় কুকর্মের নজির এ ক’বছরে জেএনইউ দেখেছে। পাশাপাশি বিজেপির ছাত্র শাখা অখিল ভারতীয় বিদ্যার্থী পরিষদ (এবিভিপি) ক্যাম্পাসের মধ্যে বিপক্ষ দলের ছাত্রছাত্রীদের ওপর হামলা পর্যন্ত চালিয়েছে। সবসময় বামপন্থি ছাত্রদের দেশবিরোধী ট্যাগ লাগিয়ে জনসমক্ষে হেনস্তা করতে সক্রিয় থেকেছে। কানাইয়া কুমার থেকে উমর খালিদ-কেউই বাদ যায়নি শাসকদের রোষানল থেকে। উমর খালিদ আজও জেলের মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন। বিনা বিচারে।
সব দেশের মতো ভারতেও কমিউনিস্ট আন্দোলন যে বহুধাবিভক্ত, তা সবার জানা। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও অন্যান্য ক্ষেত্রে এর প্রভাব পড়ে। জেএনইউ এর ব্যতিক্রম নয়। দীর্ঘদিন ধরেই সেখানে ক্ষমতার মূল কেন্দ্রে আধিপত্য সিপিআইএমএলের ছাত্রসংগঠন আইসা, ইন্ডিয়ান স্টুডেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের। তাদের সঙ্গে কয়েক বছর ধরে জোট থাকে সিপিআইএম দলের ছাত্র সংস্থা স্টুডেন্ট ফেডারেশনের অব ইন্ডিয়া, এসএফআই’র। এছাড়া কয়েক বছর আগে সিপিআইএম থেকে বেরিয়ে আসা গোষ্ঠীর ছাত্রদের সংগঠন ডেমোক্রেটিক স্টুডেন্ট ফেডারেশন ও আরও দু-একটা সংগঠনের জোট প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে বৃহত্তর স্বার্থে দেশের দক্ষিণপন্থি শক্তির বিরুদ্ধে। যদিও এই তৈলাধার পাত্র বা পাত্র ধার তৈল কতটা তাত্ত্বিক আর কতটা অকারণ আকচাআকচি, বলা কঠিন। এবার এসএফআই অজ্ঞাত কারণে বৃহত্তর বাম জোটে শামিল না হয়ে একা লড়ার সিদ্ধান্ত নেয়, যাতে প্রমাদ গোনে দেশের বাম ও গণতান্ত্রিক মহল। বীরসা আম্বেদকর ফুলে স্টুডেন্ট অ্যাসোসিয়েশন, বাপসা বলে দলিত আদিবাসীদের আরও একটি ছাত্র ইউনিট কয়েক বছর আগে আইডেন্টিটি পলিটিকসের নামে ক্যাম্পাস রাজনীতিতে ঢোকে। যদিও তাদের রাজনীতি নিয়ে বাম মহলে বিতর্ক আছে।
কেউ কেউ মনে করেন, বাপসার আসল উদ্দেশ্য বাম ছাত্রদের চিরাচরিত দলিত, আদিবাসী, মুসলিম ভোট কেটে এবিভিপির হাত শক্ত করা। সত্য-মিথ্যা যাই হোক, বাম ভোটে যে তারা ভাগ বসিয়ে অপরকে সুবিধা করে দেয়, তা নিয়ে কিন্তু প্রশ্ন নেই। প্রথমদিকে বাপসা যত প্রভাব ফেলতে পেরেছিল, ক্রমে তা অদৃশ্য হয়ে যায়। এবার তারা কোনো দাগ কাটতে পারেনি গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচনে। এসএফআইর সিদ্ধান্ত দুর্ভাগ্যজনক। দেশের পরিস্থিতি এখন এমন এক সন্ধিক্ষণে, যেখানে বাম ঐক্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। তবুও এসএফআইকে বাদ দিয়েই শেষ পর্যন্ত হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ে গুরুত্বপূর্ণ তিনটি প্যানেল-প্রেসিডেন্ট, জেনারেল সেক্রেটারি, ভাইস প্রেসিডেন্ট জিতে নেয় আইসা ডিএসএফ জোট। কেবল জয়েন্ট সেক্রেটারি পদটি দীর্ঘ নয় বছর বাদে কম মার্জিনে জেতে এবিভিপি প্রার্থী। বলাই বাহুল্য, বামেদের সার্বিক জোট হলে এই একটি আসন জেতাও এবিভিপির কাছে ছিল কষ্টকল্পনা। জেএনইউ ইলেকশন নিয়ে যারা অল্প হলেও ওয়াকিবহাল, তারা একমত হবেন যে সেখানে সবচেয়ে প্রভাবশালী প্রেসিডেন্ট পদটি। ফলে বলাই যায়, বহু চেষ্টা করেও এবারও হিন্দুত্ববাদী রাজনীতি দেশের অন্যতম সেরা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রত্যাখ্যাত হলো।
- ট্যাগ:
- মতামত
- গুজব ছড়ানো
- চাঞ্চল্যকর