গাজীপুরে প্রমাণ হলো সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব
টেবিল ঘড়ি প্রতীক নিয়ে লড়া মেয়র প্রার্থী জায়েদা খাতুন। আওয়ামী লীগের প্রতীক নৌকার প্রতি জনসমর্থনের দিক থেকে গাজীপুরকে বলা হয় দ্বিতীয় গোপালগঞ্জ। অর্থাৎ গোপালগঞ্জে যেমন নৌকা প্রতীক নিয়ে যে কেউ দাঁড়ালেই পাস করবে বলে ধরে নেওয়া হয়; গাজীপুরেও নৌকার প্রার্থীর তেমন সহজ জয় অবধারিত। কিন্তু রাজনীতির ত্রিসীমানায় না থাকা একজন গৃহবধূ জায়েদা খাতুন তা ভুল প্রমাণ করলেন। ঘোষিত ভোটের ফলাফলে দেখা যায়, তিনি পেয়েছেন ২ লাখ ৩৮ হাজার ৯৩৪ ভোট। তাঁর প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী আওয়ামী লীগের অ্যাডভোকেট আজমত উল্লা খান পেয়েছেন ২ লাখ ২২ হাজার ৭৩৭ ভোট। অর্থাৎ নৌকার প্রার্থী টেবিল ঘড়ির প্রার্থীর কাছে ১৬ হাজারেরও বেশি ভোটে হেরেছেন।
জায়েদা খাতুনের বিজয়কে অপ্রত্যাশিত বলার সময় আমার স্মরণে আছে, তাঁর হয়ে প্রকৃতপক্ষে মাঠে লড়াই করেছেন তাঁরই পুত্র– আওয়ামী লীগ থেকে বহিষ্কৃত গাজীপুর সিটির সাবেক মেযর জাহাঙ্গীর আলম। গাজীপুরের বিশেষত তরুণ ও শ্রমজীবী ভোটারদের মধ্যে জাহাঙ্গীরের একটা শক্ত সমর্থক গোষ্ঠী আছে এবং এবারের ভোটের ফল নির্ধারণে তাদের ভূমিকা খুব গুরুত্বপূর্ণ ছিল। বয়স তেমন বেশি না হলেও জাহাঙ্গীর গাজীপুর মহানগর ঘোষিত হওয়ার আগে থেকেই সেখানকার আওয়ামী লীগে নিজস্ব একটা বলয় তৈরি করতে সক্ষম হন। যার ওপর ভর করে ২০১৩ সালের প্রথম গাসিক নির্বাচনে তিনি কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের নির্দেশনার তোয়াক্কা না করেই তৎকালীন দলীয় মেয়র প্রার্থী আজমত উল্লা খানের বিরুদ্ধে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে দাঁড়িয়ে যান। বলা হয়ে থাকে, সে নির্বাচনে পোড়খাওয়া ও স্বচ্ছ ভাবমূর্তির নেতা হওয়া সত্ত্বেও আজমত উল্লা যে বিএনপি প্রার্থী আবদুল মান্নানের কাছে বিপুল ভোটের ব্যবধানে হেরে যান, তার অন্যতম কারণ ছিল তাঁর পক্ষে জাহাঙ্গীরের কাজ না করা। সম্ভবত ভোটের মাঠে জাহাঙ্গীরের এই গুরুত্ব অনুধাবন করেই দলীয় হাইকমান্ড ২০১৮ সালের গাসিক নির্বাচনে মেয়র পদে তাঁকে বেছে নেয় এবং তিনিও বেশ ভালো মার্জিনে প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপির শক্তিশালী প্রার্থীকে হারিয়ে মেয়র হন। অবশ্য মাত্র তিন বছরের মাথায় তাঁর বিরুদ্ধে এক ঘরোয়া আলোচনায় জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের সম্পর্কে কটূক্তির অভিযোগ ওঠে এবং এ কারণে তাঁকে মেয়র পদ থেকে বহিষ্কার করা হয়। তবে জাহাঙ্গীরের বক্তব্য অনুসারে, ওই বিষয়টা ছিল তাঁর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র এবং এ জন্য তিনি এককভাবে বর্তমান নৌকার প্রার্থীর দিকেই আঙুল তুলেছেন। দৃশ্যত এ ভিকটিম কার্ডও জাহাঙ্গীরের জন্য ভোটারদের একটা বড় অংশের মনকে আর্দ্র করেছে। এমনকি শাসক দল সমর্থিত অনেক কাউন্সিলর প্রার্থীও নাকি মুখে নৌকার স্লোগান তুললেও কার্যত টেবিল ঘড়ির পক্ষে কাজ করেছেন। সর্বোপরি নানা কারণে দেড় দশক ধরে ক্ষমতাসীনদের বিরুদ্ধে ভোটারদের মনে ক্ষোভ থাকাও অস্বাভাবিক নয়, জাহাঙ্গীরের সমর্থনধন্য জায়েদা খাতুনের প্রার্থিতা যা প্রকাশের সুযোগ করে দিয়েছে। সবকিছু মিলিয়ে হয়তো বলা যায়, ছেলের জনপ্রিয়তায় ভর করে মায়ের জয় না হলেই বরং তাকে অপ্রত্যাশিত বলা যেত।