
টাইফয়েড নিয়ন্ত্রণে ভ্যাকসিন জরুরি কেন?
মানুষ আদিকাল থেকেই ভয়ানক সব জীবাণুর সাথে যুদ্ধ করে টিকে আছে। এ যুদ্ধে কখনো মানুষ জয়ী হয়, কখনো জীবাণু জয়ী হয়। আমাদের শরীরে প্রাকৃতিকভাবেই রয়েছে খুব শক্তিশালী রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা। কিন্তু রোগ তৈরিকারী জীবাণুগুলো সুকৌশলে সে প্রতিরোধ ব্যবস্থা ফাঁকি দিয়ে জটিল রোগ বাধিয়ে ফেলে। এর ফলে মানুষ বিভিন্ন রোগে ভোগে, অঙ্গহানি হয় অনেক ক্ষেত্রে মৃত্যু হয়।
তবে আশার কথা হলো জীবাণুঘটিত প্রায় সব রোগই (যেমন- টাইফয়েড জ্বর, ডায়রিয়া, নিউমোনিয়া, যক্ষ্মা, ইনফ্লুয়েঞ্জা, এইডস, ডেঙ্গু, হেপাটাইটিস, ম্যালেরিয়া ইত্যাদি) প্রতিরোধযোগ্য। সঠিক স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণ করা, হাসপাতালে সংক্রমণ বিস্তার প্রতিরোধে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ‘5 Moments for Hand Hygiene’ সঠিকভাবে অনুসরণ করা, নিরাপদ পানি ও খাদ্য খাওয়া, খাবার আগে ও খাদ্য তৈরির সময় ভালো করে হাত ধোয়া, টয়লেট ব্যবহারের পর হাত ধোয়া, পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকা, মশার বিস্তার রোধ করা, অনিরাপদ যৌন সঙ্গম পরিহার করা—এ কয়টি উপায়ে ব্যাকটেরিয়া ও ভাইরাসঘটিত প্রায় সব রোগই প্রতিরোধ করা সম্ভব।
জীবাণু সংক্রমণ প্রতিরোধের আরেকটি বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি হলো টিকা বা ভ্যাকসিন। টিকা বা ভ্যাকসিন কোনো নির্দিষ্ট জীবাণুর বিরুদ্ধে মানুষের শরীরে একধরনের ইমিউন মেমরি তৈরির মাধ্যমে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে অনেকগুণে বাড়িয়ে দেয়, ফলে, সে রোগের কোনো জীবাণু শরীরে প্রবেশের সাথে সাথে প্রচুর অ্যান্টিবডি তৈরির মাধ্যমে সে জীবাণুকে ধ্বংস করে ফেলে।
ভ্যাকসিন ব্যবহারের মাধ্যমে কয়েকটি রোগ পৃথিবী থেক নির্মূল হয়ে গেছে, যেমন-গুটি বসন্ত (small pox) এবং পোলিও। ভ্যাকসিন কিছু রোগের সংক্রমণ মারাত্মকভাবে কমিয়ে দিয়েছে যেমন- হাম (measles), জার্মান হাম (Rubella), মাম্পস, জলাতঙ্ক (Rabies), ধনুষ্টংকার (Tetanus), হেপাটাইটিস বি, ইনফ্লুয়েঞ্জা বি, ডেঙ্গু, মেনিজাইটিস, টাইফয়েড জ্বর ইত্যাদি। এসব ভ্যাকসিনের ফলে বিশ্বব্যাপী কোটি কোটি মানুষের জীবন রক্ষা পেয়েছে।
টাইফয়েড জ্বর কী?
টাইফয়েড জ্বর বা সাধারণভাবে ‘টাইফয়েড’ একটি ব্যাকটেরিয়াঘটিত রোগ। স্যালমোনেলা এন্টারিকা সেরোটাইপ টাইফি (Salmonella enterica serotype Typhi) বা স্যালমোনেলা টাইফি নামক এক ধরনের গ্রাম-নেগেটিভ রড আকৃতির ব্যাকটেরিয়া দিয়ে টাইফয়েড জ্বর হয়। এ ব্যাকটেরিয়াটি ফিক্যল-ওরাল রুট অর্থাৎ মানুষের মল-মূত্র দিয়ে দূষিত পানি ও খাবারের মাধ্যমে ছড়ায়।
স্যালমোনেলা এন্টারিকার (Salmonella enterica) আরও তিনটি সেরোটাইপ আছে- Salmonella enterica serotype Paratyphi A, B and C। প্যারাটাইফি সেরোটাইপগুলো দিয়ে যে রোগ হয় তাকে প্যারাটাইফয়েড জ্বর বলে। প্যারাটাইফয়েড জ্বর টাইফয়েড জ্বরের মতো অতোটা ভয়ানক নয়।
প্যারাটাইফি সেরোটাইপের তুলনায় টাইফি সেরোটাইপ অনেক বেশি ভয়ানক হওয়ার পেছনে মূল কারণ হলো টাইফি সেরোটাইপের আউটার মেমব্রেনের অবস্থিত ক্যাপসুলে ভিআই অ্যান্টিজেনের (Vi antigen) উপস্থিতি। এ ভিআই অ্যান্টিজেনের উপস্থিতি স্যালমোনেলা টাইফিকে আমাদের রোগ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা বা ইমিউন সিস্টেমের আক্রমণ থেকে রক্ষা করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এ কারণে টাইফি সেরোটাইপঘটিত টাইফয়েড জ্বর অনেক বেশি সংক্রমণক্ষম ও ক্ষতিকর।
টাইফয়েড জ্বরের প্রধান লক্ষণ হলো উচ্চমাত্রার জ্বর (১০৪ ডিগ্রি ফারেনহাইট), অবসাদ, মাথাব্যথা, বমিবমি ভাব, পেটে ব্যথা, কোষ্ঠকাঠিন্য বা ডায়রিয়া।
টাইফি এবং প্যারাটাইফি সেরোটাইপ উভয়ই অন্ত্রে আক্রমণ করে প্রদাহ, ক্ষত বা ঘা এবং অনেক সময় অন্ত্রে ছিদ্র তৈরি করতে পারে। সময়মতো সঠিক চিকিৎসা না হলে টাইফি সেরোটাইপ শরীরের অন্য অংশে যেমন লিভার, ফুসফুস, প্লীহা, গল ব্লাডারে ছড়িয়ে পড়ে রোগীর মারাত্মক ক্ষতি করে দিতে সক্ষম।
টাইফয়েড এবং প্যারাটাইফয়েডের জীবাণু শরীরে প্রবেশের ৫-১৪ দিনের মধ্যে লক্ষণ প্রকাশ পায়। তাই, কোন উৎস থেকে টাইফয়েড সংক্রমিত হয়েছে তা নির্ণয় করা সহজ নয়।
বিশ্বে টাইফয়েড জ্বরে আক্রান্তের হার কেমন এবং কারা বেশি আক্রান্ত হয়?
২০২৫ সালের সেপ্টেম্বর বিখ্যাত ল্যানসেট জার্নালে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন অনুযায়ী শুধুমাত্র ২০২১ সালে বিশ্বে টাইফয়েড ও প্যরাটাইফয়েড মিলিয়ে প্রায় ৯৩ লক্ষ মানুষ আন্ত্রিক জ্বরে আক্রান্ত হয়েছিল, যার মধ্যে মারা গিয়েছিলো প্রায় এক লাখ মানুষ (তথ্যসূত্র: ১)। অন্য বয়সের তুলনায় ৫-১৫ বছরের শিশুদের টাইফয়েডে আক্রান্ত হওয়ার সংখ্যা ছিল বেশি।
- ট্যাগ:
- মতামত
- টিকাদান কর্মসূচি
- টাইফয়েড