চীনা পণ্যের আমদানিনির্ভরতা থেকে বেরিয়ে আসার কোনো উপায় আছে?
চীনের বাণিজ্য উদ্বৃত্ত যখন বাড়ছে এবং তার উৎপাদিত পণ্যের রফতানি ক্রমে বিশ্ববাজার দখল করছে, তখন বিশ্বের অন্যান্য দেশ কীভাবে প্রতিক্রিয়া জানাবে তা নিয়ে হতবিহ্বল মনে হচ্ছে। দেশগুলো কি চীনের বিরুদ্ধে বাণিজ্য প্রতিবন্ধকতা দাঁড় করাবে? উৎপাদন পুনর্বিন্যাস করে দেশীয় সরবরাহ শৃঙ্খল তৈরির মাধ্যমে কি চীন থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার চেষ্টা করবে? নাকি শিল্পনীতি প্রয়োগ করে চীনের মতোই উৎপাদন খাতকে জোরদার করতে চাইবে?
নীতিনির্ধারকদের শুরুতেই প্রশ্ন করতে হবে: চীনা রফতানির সমস্যা কোথায়? কারণ সস্তা আমদানিই তো বৈদেশিক বাণিজ্যে লাভের প্রতীক। নবায়নযোগ্য জ্বালানির মতো গুরুত্বপূর্ণ খাতে চীনের উদ্ভাবন ও উৎপাদন দক্ষতা বৈশ্বিক জলবায়ুর উপকার বয়ে এনেছে, যা এক ধরনের বৈশ্বিক জনকল্যাণমূলক কাজ। আবার দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য ঘাটতি নিজে নিজে খুব বড় বিষয় নয়। বড় ধরনের মোট বাণিজ্য ভারসাম্যহীনতা সমস্যার কারণ হতে পারে, কিন্তু এগুলো খাতভিত্তিক চীনবিরোধী কৌশলের বদলে সামষ্টিক অর্থনৈতিক নীতিতেই ভালোভাবে সামলানো যায়।
তবু চীনা রফতানি সমস্যাগ্রস্ত হওয়ার তিনটি যৌক্তিক কারণ রয়েছে—জাতীয় নিরাপত্তা, উদ্ভাবন ক্ষয় এবং কর্মসংস্থান। প্রত্যেকটির জন্য প্রয়োজন আলাদা কৌশল। কিন্তু আজকের নীতিনির্ধারকরা এগুলোকে গুলিয়ে ফেলায় নীতি-পরিণতিও হয়েছে খারাপ।
জাতীয় নিরাপত্তা দিয়ে শুরু করা যাক। যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের নেতারা ক্রমে চীনকে প্রতিদ্বন্দ্বী ও ভূরাজনৈতিক হুমকি হিসেবে দেখছেন। সে কারণেই প্রতিরক্ষা ও কৌশলগত খাতের স্বার্থরক্ষায়—সমালোচনামূলক সামরিক সরঞ্জাম বা সংবেদনশীল প্রযুক্তিতে নির্ভরতা কমাতে—বাণিজ্য ও শিল্পনীতিকে সমর্থন করা যৌক্তিক। এমন উদ্যোগ নেয়া হলে সরকারগুলোর দায়িত্ব হলো নাগরিকদের এবং চীনকেও, যাতে উত্তেজনা না বাড়ে—স্পষ্ট করে দেখানো যে এ নীতিগুলো কেবল নিরাপত্তা সম্পর্কিত পণ্য, সেবা ও প্রযুক্তিতেই লক্ষ্যপূর্ণভাবে প্রয়োগ করা হচ্ছে এবং লক্ষ্য অতিক্রম করছে না।
এক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জেক সুলিভানের ব্যাখ্যা করা ‘ছোট উঠান, উঁচু বেড়া’ (স্মল ইয়ার্ড, হাই ফেন্স) কৌশলটি এখনো সবচেয়ে কার্যকর পন্থা হতে পারে। আন্তরিকভাবে প্রয়োগ করা হলে এটি জাতীয় নিরাপত্তার নামে বাণিজ্য নীতির ব্যবহারকে শৃঙ্খলায় রাখবে। একই সঙ্গে পারস্পরিক ব্যাখ্যা ও সংলাপ উৎসাহিত করবে, যা অপ্রয়োজনীয় উত্তেজনা এড়াতে সাহায্য করবে।
এরপর উদ্ভাবনের প্রশ্ন আসে। এখানে উদ্বেগ হলো, চীনা রফতানি আমদানিকারক দেশের উদ্ভাবনী সক্ষমতাকে ক্ষুণ্ন করতে পারে, যা ভবিষ্যৎ সমৃদ্ধির সম্ভাবনাকে দুর্বল করে। উন্নত অর্থনীতিগুলোতে উৎপাদন খাতে কর্মসংস্থান কমে গেলেও এ খাত এখনো গবেষণা এবং উন্নয়ন (আরঅ্যান্ডডি) এবং উদ্ভাবন ছড়িয়ে পড়ার সবচেয়ে বড় উৎস। চীনা আমদানির চাপে এসব কার্যক্রম সংকুচিত হলে বৈদেশিক বাণিজ্যে লাভ কমে যায়, এমনকি লোকসানে পরিণত হয়।
এ সমস্যা মোকাবেলায়ও দরকার সূক্ষ্ম ও স্বতন্ত্র নীতি। নীতির লক্ষ্য হওয়া উচিত উৎপাদন খাতের সেই উন্নত অংশগুলো, যেখান থেকে নতুন প্রযুক্তি এবং উদ্ভাবনী বহিঃপ্রভাবের সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি। ভোক্তা পণ্য বা মানসম্পন্ন প্রযুক্তিনির্ভর প্রতিষ্ঠিত শিল্প রক্ষা করা অর্থহীন। উদাহরণস্বরূপ গাড়ি শিল্পে যুক্তরাষ্ট্র ও জার্মানির উচিত পরবর্তী প্রজন্মের বৈদ্যুতিক গাড়িতে (ইভি) মনোযোগ দেয়া—সেখানে নয় যেখানে চীন এরই মধ্যে ব্যাপক উৎপাদনে দক্ষতা অর্জন করেছে।
উন্নত প্রযুক্তি খাতে চীনা রফতানির মোকাবেলার সঠিক পথ হলো আধুনিক শিল্পনীতি প্রয়োগ যেখানে সরকারি সমন্বয়, প্রয়োজনীয় ইনপুট সরবরাহ এবং প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে ভর্তুকির মাধ্যমে বিনিয়োগ ও উদ্ভাবনকে উৎসাহিত করা হবে। অর্থাৎ অন্যান্য দেশকে চীনের শিল্পনীতির ন্যায়পন্থা অনুকরণ করতে হবে, তবে নিজের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও প্রাতিষ্ঠানিক বাস্তবতার সঙ্গে মানিয়ে। আমদানি সুরক্ষা এখানে সর্বোচ্চ সাময়িক ঢাল; দীর্ঘমেয়াদে ফল দেবে কেবল শক্তিশালী শিল্পনীতি।
সবশেষে আলোচনা আসছে কর্মসংস্থানের বিষয়ে। চীনা আমদানির ফলে কর্মসংস্থানে ক্ষতি, বিশেষত সেই পিছিয়ে থাকা অঞ্চলে যেখানে প্রতিযোগী শিল্প ঘনীভূত—একটি বাস্তব উদ্বেগ। এটি শুধু সাম্যবিধানের বিষয় নয়। যেসব অঞ্চলে চাকরি নষ্ট হয় সেখানেই দেখা যায় সামাজিক ও রাজনৈতিক অস্থিরতা: অপরাধ বৃদ্ধি, পরিবার ভাঙন, মাদকাসক্তি, মৃত্যুহার বৃদ্ধি ও কর্তৃত্ববাদী জনতুষ্টি মতবাদে সমর্থন।