সুর ও অসুরের দ্বন্দ্ব আর কত দিন
২০১৬ সালে ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরের প্রাণকেন্দ্রে কুমারশীল রোডে অবস্থিত ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁর পৈতৃক বাড়ি তথা সংগীত একাডেমিতে ধর্মান্ধদের হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা নিশ্চয় এখনো কারও কারও মনে আছে। ১৯৭৩ সালে গঠিত সেই একাডেমিতে আলাউদ্দিন খাঁর স্মৃতিবিজড়িত ও ব্যবহৃত সংগীতযন্ত্র, চিঠিপত্র ও বিভিন্ন প্রামাণিক দলিল ছিল। মানে ওটা একটা জাদুঘর ছিল। জাদুঘরের প্রায় পুরোটাই পুড়িয়ে ছাই করে দেওয়া হয়।
সর্বশেষ আমরা দেখলাম মানিকগঞ্জের বিখ্যাত পালাগানের শিল্পী আবুল সরকারকে গ্রেপ্তারের ঘটনা। ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের অভিযোগে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়। পালাগানের শিল্পীরা একেকটি আসরে যে বাহাস করেন, সেখানে পরম ও জীবের ভূমিকায় অভিনয় করতে হয়। জীবের ভূমিকায় যিনি থাকেন, তাঁর নানা ধরনের শিশুসুলভ প্রশ্ন করতে হয়। সেসব প্রশ্নের উত্তর দেন অপর পক্ষের আরেকজন শিল্পী। আর এর মাধ্যমে মূলত পরমের মহিমাই প্রতিষ্ঠা করা হয়। কিন্তু আমরা দেখলাম স্রেফ একটি ভূমিকায় অবতীর্ণ হওয়ার জন্য একজন শিল্পীকে গ্রেপ্তার করা হলো। এটি অনেকটা চলচ্চিত্রে ধর্ষণের অভিনয় করার জন্য একজন খলনায়ক অভিনেতাকে গ্রেপ্তার করার মতো। পালাগান বা কবিগান সম্পর্কে যাঁদের ধারণা আছে, তাঁরা জানেন, গীতিকবিরা মূলত গানের ছলে বাহাস করেন এবং পরমেশ্বরের সঙ্গে তাঁদের মধুর সম্পর্ককে তুলে ধরেন। এই বাহাস হয় গ্রামীণ মানুষের মুখের ভাষায়। এই চর্চা যুগ যুগ ধরেই চলে আসছে। গ্রামের সাধারণ মানুষ সেসব বাহাস শুনে হাসে, কাঁদে ও আনন্দ পায়। তারা ধর্মান্ধ নয় বলে তাদের অনুভূতিতে আঘাত লাগে না। তারা বরং গোটা বিষয়টিকে একটি ‘পারফর্মিং আর্ট’ হিসেবে দেখে।
এখন আবুল সরকারের গ্রেপ্তারের পেছনে মূল কারণটা মনে হচ্ছে, তিনি ওই আসরটিতে একটি ধর্মভিত্তিক দলের ব্যাপারে সংশয় প্রকাশ করে বলেছিলেন, এরা ক্ষমতায় গেলে গানবাজনা বন্ধ হয়ে যাবে। আর এই রাজনৈতিক বয়ানই বোধ হয় তাঁর জন্য কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে।
অবশ্য শুধু আবুল সরকারই নন, পালাগানে জীবের ভূমিকায় গান ও বাহাস পরিবেশনের জন্য ২০২০ সালে বাউলশিল্পী রীতা দেওয়ানও গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। তাঁর নামে আটটি মামলা হয়েছিল। এই তথ্যটি আবুল সরকারের আলোচিত পালাগানের আসরের শুরুতেই রয়েছে। তিনি শুরুতেই বলেছিলেন, রীতা দেওয়ান মামলা খেয়েছেন আটটি। তাঁর কপালেও এমন হতে পারে। হলোও তাই। আবুল সরকারের মতো ২০২০ সালে শরিয়ত সরকার নামের আরেক বয়াতিকেও ইসলাম ধর্মকে কটূক্তির অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয়।
এভাবে চলতে থাকলে একটা সময় বাংলাদেশের ঐতিহ্যের পরিচায়ক পালাগানটাই বন্ধ হয়ে যাবে। বেশ পরিকল্পিতভাবে, ধীরে ধীরে বাংলার সংস্কৃতিকে উচ্ছেদ করে এখানে ধর্মীয় আচারকে চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে। ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের কথা বলে সংগীত ও শিল্পীর ওপর আক্রমণের এই সংস্কৃতি বিগত সরকারের আমলে যেমন হয়েছে, এখনো হচ্ছে। বলা যেতে পারে, এই আগ্রাসী সংস্কৃতি অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে আরও বেশি বেগবান হয়েছে। সংগীত অনুষ্ঠান বন্ধ, বাতিল ও পণ্ড করা ছাড়াও, গানবাজনা হওয়া ডজনখানেক মাজারে চালানো হয়েছে ভাঙচুর।
কয়েকটি উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে: ২০২৪ সালের ২৫ নভেম্বর যশোরে বাউলশিল্পীদের দুই দিনব্যাপী সাধুসংঘের বাউলগানের আসর বন্ধ করা হয়। ২০২৫ সালের জানুয়ারিতে নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লায় বাউলগানের আসর বন্ধ করে সেখান থেকে বাদ্যযন্ত্র জব্দ করে পুলিশ। পরের মাসেই মানিকগঞ্জের সিংগাইরে প্রয়াত বাউলশিল্পী রশিদ সরকারের ‘সাধুর মেলা’ পণ্ড হয়ে যায় স্থানীয় লোকজনের বাধার মুখে। আর কিছুদিন আগে আবুল সরকারকে গ্রেপ্তার ও পরবর্তী সময়ে তাঁর অনুসারীদের ওপর ‘তৌহিদি জনতা’র নাম দিয়ে আক্রমণ ও আহত করার ঘটনা ঘটে। এর কয়েক ঘণ্টার ভেতরেই ঠাকুরগাঁওয়ে একই নামধারী জনতা হামলা চালায় বাউলশিল্পীদের ওপর এবং কয়েকজনকে আহত করে। এমন হামলার ঘটনা সারা দেশেই ছড়িয়ে পড়েছে।
এমন প্রবণতা সমাজে আসলে গত কয়েক দশক ধরেই তৈরি হয়েছে। অপরকে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার প্রবণতা। বাউলদের বিরোধিতা শত শত বছর ধরেই এখানে রয়েছে। কারণ, বাউলরা পরমের সঙ্গে নিজেদের সম্পর্ক প্রেমের পর্যায়ে নিয়ে যায়, যা অন্য ধর্মান্ধদের কাছে প্রভু ও ভৃত্যের সম্পর্ক। কাজেই বিশ্বাসের এই পার্থক্য আছে বলেই সমাজে বাউলরা ব্রাত্য। তাঁদের ওপর হামলার ঘটনাও নতুন নয়। কিন্তু বর্তমান বাংলাদেশে বাউলদের ওপর যে রকম সমন্বিত হামলার রূপ দেখা যাচ্ছে, সেটি একেবারেই নতুন। স্বাভাবিক, নতুন প্রজন্মের কাছে এখন যোগাযোগের উন্নত সব প্রযুক্তি রয়েছে। বাউলশিল্পীরা সেসব প্রযুক্তির নেতিবাচক ব্যবহার তো দূরে থাক, তাঁরা শিল্পসাধনা করেই কূল পান না। কিন্তু এই সুযোগে তো সুরের বিপরীতে, যারা অসুর, তারা বসে থাকবে না!
অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে যারা কয়েক ডজন মাজার ভেঙেছে, এমনকি মাজারের মৃত পীরকে কবর থেকে তুলে পুড়িয়ে দিয়েছে, সেই একই গোষ্ঠীর চাপ এখন প্রসারিত হয়েছে সরকারের ওপর। এ কারণেই সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সংগীত ও শরীরচর্চার শিক্ষক নিয়োগের সিদ্ধান্ত বাতিল করা হয় প্রজ্ঞাপন জারি করে।
বিবিসি বাংলার প্রতিবেদনে লেখা হয়েছে: ‘সংগীত ও শারীরিক শিক্ষক নিয়োগের ঘোষণা আসার পর থেকেই এ নিয়ে আপত্তি জানাতে শুরু করে কয়েকটি ধর্মভিত্তিক সংগঠন ও রাজনৈতিক দল। এই সিদ্ধান্ত বাতিলের দাবিতে নানা কর্মসূচিও পালন করে তারা। এ ছাড়া সংগীত শিক্ষকের বদলে ধর্ম শিক্ষক নিয়োগের দাবিও জানানো হয়।’
বাংলাদেশের চিত্রটি এখন খুব স্পষ্ট। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সংগীতের শিক্ষক নিয়োগ বাতিল থেকে শুরু করে মাজারের ওপর হামলা, একের পর এক সংগীতানুষ্ঠান বাতিল এবং ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের অভিযোগ এনে বাউলশিল্পীদের ওপর আক্রমণ ও গ্রেপ্তারের মাধ্যমে একটা বিষয় পরিষ্কার হয়ে গেছে, সমাজের একটি মৌলবাদী গোষ্ঠী বেশ সোচ্চার হয়ে উঠেছে এবং সরকার ও রাষ্ট্রের মদদে ও সমর্থনে তারা দিনকে দিন বেপরোয়া হয়ে উঠছে। এমনভাবে চলতে থাকলে বাংলাদেশে ধর্মীয় সমন্বয়বাদ ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি হুমকির মুখে পড়বে। অবশ্য দেশে আর এসবের কিছুই অবশিষ্ট নেই। যা আছে, তা বিগত দিনের অবশিষ্ট চিহ্নমাত্র।
- ট্যাগ:
- মতামত
- বাউল শিল্পী
- হামলার শিকার