প্রতিবিপ্লবী তৎপরতা : জুলাই বিপ্লবের গর্ব হাইজ্যাক
বিশ্বাস-অবিশ্বাসের দোলাচলে দুলছে বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গন। ফ্যাসিবাদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে যারা একদিন ঐক্যবদ্ধ হয়েছিলেন রাজপথে, তারা এখন সাধারণ নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় যাওয়ার প্রতিযোগিতায় বিভক্ত হয়ে পড়েছেন।
ভবিষ্যতে ফ্যাসিস্ট বা স্বৈরশাসকের উত্থান যাতে না ঘটে, তা রুখে দেওয়ার জন্য বাস্তবমুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করার কোনো প্রবণতা নেই অনেকের মধ্যে। যারা ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক আন্দোলন করতে করতে বয়ঃবৃদ্ধ হয়ে গেছেন, অতীতে সংসদ-সদস্য নির্বাচিত হতে পারেননি, তাদের অনেকেই অতিদ্রুত নামের পেছনে যাতে ‘সংসদ-সদস্য’ পদ লিখতে পারেন, তার জন্য ভীষণ উতলা হয়ে উঠেছেন।
ভাবখানা এরকম, দেশ এবং গণতন্ত্র বাঁচানোর চিন্তাভাবনা পরে করা যাবে, কিন্তু খালি মাঠে গোল (আওয়ামী লীগ, ১৪ দল ও জাতীয় পার্টিবিহীন রাজনৈতিক মাঠ) দিয়ে সংসদ সদস্যপদ জীবনে একবার হলেও পেতে হবে এবং তা এখনি হতে হবে। তাদের প্রশ্ন : ফেব্রুয়ারি মাস আসতে কেন এত সময় লাগছে?
গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়া যায়নি
বর্তমান সংবিধান অনুযায়ী, জাতীয় সংসদ নির্বাচন গত ৫৪ বছরে বহুবার অনুষ্ঠিত হয়েছে; কিন্তু সেই সংসদ দেশে গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে পারেনি, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি, মানবাধিকার লঙ্ঘন ঠেকাতে পারেনি বরং নির্বাচনের মাধ্যমে সৃষ্ট হয়েছে এক মহাদুর্নীতিবাজ সমাজব্যবস্থা, তৈরি হয়েছে দুষ্ট ব্যবসায়ী চক্র (অলিগার্ক), যারা রাজনৈতিক অঙ্গন স্থায়ীভাবে কিনে নিয়েছে। এ চক্র সব রাজনৈতিক দলের মধ্যে ঢুকে পড়েছে, এরা সবাইকে অর্থ দেয় (অনেকেই একে চাঁদাবাজি বলে); যারাই ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হোক না কেন, তারাই এ দুর্নীতিবাজ ব্যবসায়ী চক্রের ব্ল্যাকহোলে ঢুকে পড়েছে, এখান থেকে বাইরে আসার কোনো শক্তি তাদের নেই।
২২ পরিবারের স্থলে কয়েক ডজন অলিগার্ক
পাকিস্তান আমলে ২২ পরিবারের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে ১৯৬৯ এবং ১৯৭১-এ বিজয়ী হওয়া গেছে; কিন্তু এখন ফ্যাসিস্টসৃষ্ট কয়েক ডজন নব্য দুষ্ট ব্যবসায়ী পরিবারের (অলিগার্ক) বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেও কোনো ফলাফল পাওয়া গেল না। গত ২০২৪-এর গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমেও এদের প্রভু ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার পতন হলেও এদের নবউত্থান হয়েছে, এরা অসৎ রাজনীতিকদের ছায়াতলে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছে, ফলে জনগণ এদের অত্যাচারের শিকার হচ্ছে, কোনো পরিত্রাণ পাওয়া যাচ্ছে না।
এ ধরনের গণবিরোধী, গণবিধ্বংসী, সমাজবিরোধী এবং প্রতিক্রিয়াশীল রাজনৈতিক বন্দোবস্তের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে ২০২৪-এর গণ-অভ্যুত্থানের পরে কয়েকটি রাজনৈতিক সংগঠন রাষ্ট্র সংস্কারের কথা বলেছিল এবং বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারও অনেক সংস্কার কমিশন গঠন করে বিশদ প্রস্তাব পেশ করেছে, যার বৈধতা (ভ্যালিডেশন) দেওয়ার কথা ছিল গণভোটের মাধ্যমে। কিন্তু সাধারণ নির্বাচনের আগে গণভোটে রাজি নয় কয়েকটি রাজনৈতিক দল।
গণভোট ও সংসদ নির্বাচন
ফ্যাসিস্ট কর্তৃক সৃষ্ট গণবিরোধী রাষ্ট্রব্যবস্থাপনা থেকে গণমুখী বন্দোবস্তের দিকে যেতে গণভোট এবং সংসদ নির্বাচন, দুটোই গুরুত্বপূর্ণ। সম্পূর্ণ শান্তিপূর্ণ পরিবেশে একইদিনে, একই সময়ে দুটো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে জনগণের ম্যান্ডেট নেওয়া নিঃসন্দেহে হিমালয় পর্বত হেঁটে পার হওয়ার মতো কঠিন কাজ।
তবুও কিছু কিছু রাজনৈতিক দলকে সন্তুষ্ট রাখতে গিয়ে অন্তর্বর্তী সরকার গণভোট এবং জাতীয় সংসদ নির্বাচন একইদিনে, একসঙ্গে অনুষ্ঠান করার ঘোষণা দিয়েছেন। তবে একইদিনে নির্বাচন ও গণভোট করা চ্যালেঞ্জিং বলে জানিয়েছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এএমএম নাসির উদ্দিন। রাজধানীর গুলশানে এশিয়ান নেটওয়ার্ক ফর ফ্রি ইলেকশনসের আয়োজনে নির্বাচনবিষয়ক এক কর্মশালায় ২২ নভেম্বর তিনি বলেন, একইদিনে নির্বাচন ও গণভোট করার জন্য এমন মুখোমুখি পরিস্থিতিতে পূর্ববর্তী নির্বাচন কমিশন কখনো পড়েনি।
টু-ইন-ওয়ান : গণভোট ও নির্বাচন একসঙ্গে
জাতির উদ্দেশে সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নভেম্বর ১৩, ২০২৫-এ দেওয়া ভাষণে গণভোট এবং জাতীয় সংসদ নির্বাচন এক দিনে অনুষ্ঠানের কথা বলা হয়েছে। তবে আগামী বছরের ফেব্রুয়ারির মাসের প্রথম সপ্তাহে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের চিন্তাভাবনা থাকলেও তা সময়ের স্বল্পতার কারণে অনুষ্ঠিত হতে পারবে কিনা, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে সংশ্লিষ্ট মহলে।
টাইম অ্যান্ড স্পেস
তবে হাতে থাকা সময় এবং বাস্তব অবস্থা (টাইম অ্যান্ড স্পেস) বিবেচনা করলে ফেব্রুয়ারি মাসের প্রথম সপ্তাহে গণভোট এবং জাতীয় সংসদ নির্বাচন একইসঙ্গে অনুষ্ঠান করা অসম্ভব বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। পেছন থেকে সময় গণনা (ব্যাকওয়ার্ড ক্যালকুলেশন অফ টাইম) করলে বোঝা যাবে ফেব্রুয়ারি মাসে নির্বাচন করা কতটা অসম্ভব :
* ৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২৬-এ (বৃহস্পতিবার) উভয় নির্বাচন একসঙ্গে অনুষ্ঠিত হলে হাতে সময় থাকে মাত্র ৭০ দিন।
* শুক্র, শনিবার ও সরকারি ছুটির দিন বাদ গেলে থাকে ৪৭ দিন।
* ৪৭ দিনের মধ্যে ডাবল ব্যালট পেপার ছাপানো, ডাবল ব্যালট বাক্সের ব্যবস্থা করা, ভোটকেন্দ্র মেরামত, প্রিসাইডিং অফিসার নিয়োগ এবং প্রশিক্ষণ দেওয়া, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে প্রস্তুত করা, রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করা, গণভোটের প্রয়োজনীয়তা এবং গণভোটদানের পদ্ধতি সম্পর্কে ভোটারদের অবহিতকরণ-সব মিলিয়ে ডাবল নির্বাচনের মহাযজ্ঞের বৈতরণী পার হওয়া ভার্জিন নির্বাচন কমিশনের (যাদের অতীতে কোনো নির্বাচন সম্পন্ন করার অভিজ্ঞতা নেই) পক্ষে সম্ভব কিনা, তা দেখার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
যারা দ্রুত নির্বাচন করে ক্ষমতাসীন হওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছেন, তারা এসব প্রতিকূলতা কীভাবে মোকাবিলা করবেন, তা দেখার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।
- ট্যাগ:
- মতামত
- প্রতিবিপ্লব
- জুলাই বিপ্লব