পৃথিবীর সংকট নিরসনে মহাকাশ অভিযান
সাম্প্রতিক সময়ে গণমাধ্যমে একটি সংবাদ বিশেষভাবে আলোচিত হচ্ছে—পৃথিবীর তেল ও গ্যাসের ভান্ডার ফুরিয়ে আসছে। এই সংকট শুধু বাংলাদেশের নয়, এটি একটি বৈশ্বিক বাস্তবতা। জীবাশ্ম জ্বালানির এই অবশ্যম্ভাবী সমাপ্তিই শক্তিধর দেশগুলোকে এর অবশিষ্ট ভান্ডারের ওপর নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখার জন্য এক মরিয়া প্রতিযোগিতায় নামিয়েছে। এর করুণ পরিণতি আমরা দেখতে পাচ্ছি মধ্যপ্রাচ্যের বুকে। ইরাক, সিরিয়া ও লিবিয়ার মতো দেশগুলো শুধু খনিজ তেল ও গ্যাসের দখলকে কেন্দ্র করে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে উপনীত হয়েছে। চলমান ইউক্রেন যুদ্ধও ভূ-রাজনৈতিক গুরুত্বের চেয়ে খনিজ সম্পদের নিয়ন্ত্রণের লড়াই হিসেবেই বেশি প্রাসঙ্গিক। রাষ্ট্রপ্রধানদের শান্তি আলোচনার আড়ালে শক্তির মহড়াই যেন বেশি প্রাধান্য পাচ্ছে।
এই সংকটের প্রেক্ষাপটেই নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচিত হচ্ছে। সম্প্রতি পৃথিবীর একমাত্র উপগ্রহ চাঁদে চালানো কয়েকটি অভিযানে এটি প্রায় নিশ্চিত যে সেখানে বিপুল পরিমাণ খনিজের সম্ভাবনা বিরাজ করছে—এর একটি উদাহরণ হলো হিলিয়াম ৩। শুধু চাঁদেই নয়, আমাদের সৌরজগতের মধ্যেই সম্পদের প্রাচুর্য বিজ্ঞানীদের আশাবাদী করছে। পাশাপাশি, নবায়নযোগ্য জ্বালানি এবং সৌরশক্তির ব্যবহার সংকট উত্তরণের নতুন পথ দেখাচ্ছে। পৃথিবীর সব দেশের একটি সমন্বিত উদ্যোগ এই সংকট থেকে মানবজাতিকে স্থায়ীভাবে মুক্তি দিতে পারে। আর এই মুক্তির পথ মহাকাশের দিকেই প্রসারিত।
মহাজাগতিক দর্শন
বিখ্যাত জ্যোতির্বিজ্ঞানী ও বিজ্ঞান যোগাযোগকারী কার্ল সাগান মহাকাশ অভিযানকে মানবজাতির জন্য অপরিহার্য বলে মনে করতেন। তাঁর মতে, পৃথিবীর স্নায়ুযুদ্ধ, আধিপত্যের রাজনীতি এবং সভ্যতার অবক্ষয়ের পেছনে সম্পদের সীমাবদ্ধতা একটি বড় কারণ। সাগানের কাছে মহাকাশ অনুসন্ধান কোনো বিলাসিতা ছিল না, বরং এটি ছিল মানবজাতির দীর্ঘমেয়াদি অস্তিত্ব রক্ষার একমাত্র উপায়।
তিনি পৃথিবীকে মহাবিশ্বের এক ‘ফ্যাকাশে নীল বিন্দু’ (পেইল ব্লু ডট) হিসেবে আখ্যায়িত করে আমাদের ভঙ্গুরতাকে তুলে ধরেছিলেন। গ্রহাণুর আঘাত, জলবায়ু পরিবর্তন বা পারমাণবিক যুদ্ধের মতো বিপর্যয় যেকোনো মুহূর্তে আমাদের অস্তিত্বকে বিপন্ন করতে পারে। সাগান বিশ্বাস করতেন, একমাত্র বহু-গ্রহীয় প্রজাতি (মাল্টি-প্ল্যানেটারি স্পিশিজ) হিসেবেই মানুষ এই মহাজাগতিক বিপদ থেকে নিজেদের রক্ষা করতে পারে। তাই অস্তিত্ব রক্ষার তাগিদেই মহাকাশে উপনিবেশ স্থাপন জরুরি।
সাগানের দর্শন অনুযায়ী, মানুষের মধ্যে জ্ঞান অন্বেষণের এক সহজাত কৌতূহল রয়েছে। মহাকাশ আমাদের সেই কৌতূহলকে তৃপ্ত করে এবং মহাবিশ্বে আমাদের অবস্থান সম্পর্কে এক গভীর অন্তর্দৃষ্টি দেয়। তাঁর বিখ্যাত উক্তি, ‘আমরা নক্ষত্রের সন্তান’ (উই আর মেইড অব স্টার-স্টাফ), এই ধারণাকে প্রতিষ্ঠা করে যে মহাবিশ্বকে জানার মাধ্যমেই মানুষ নিজেকে জানতে পারে।
কার্ল সাগানের দর্শনেরই আধুনিক প্রতিধ্বনি শোনা যায় একুশ শতকের পদার্থবিজ্ঞানী ও বিজ্ঞান উপস্থাপক ব্রায়ান কক্সের কণ্ঠে। কক্সের মতে, আমরা আজ এক ‘মহাকাশচারী সভ্যতা’ হওয়ার দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে আছি। গত দশকে প্রকৌশলগত বিপ্লব, বিশেষ করে স্পেসএক্স এবং ব্লু অরিজিনের মতো কোম্পানির পুনর্ব্যবহারযোগ্য রকেট প্রযুক্তি, মহাকাশে প্রবেশকে আগের চেয়ে অনেক সহজ ও সাশ্রয়ী করেছে।
কক্স ভবিষ্যতের যে চিত্র এঁকেছেন, সেখানে পৃথিবীর কক্ষপথে কেবল একটি নয়, বরং একাধিক মহাকাশ স্টেশন থাকবে, যা বৈজ্ঞানিক ও বাণিজ্যিক গবেষণার কেন্দ্র হয়ে উঠবে। মহাকাশ পর্যটন এবং স্টারলিংকের মতো স্যাটেলাইট নেটওয়ার্ক বিশ্বজুড়ে উচ্চগতির ইন্টারনেট সরবরাহ করবে। তিনি জোর দিয়ে বলেন, গ্রহাণু থেকে খনিজ আহরণ বা মঙ্গলে শহর গড়ার মতো দূরবর্তী স্বপ্নের আগে, পৃথিবীর নিকটবর্তী কক্ষপথেই এক নতুন অর্থনৈতিক দিগন্ত উন্মোচিত হচ্ছে। গ্রহাণু থেকে খনিজ সম্পদ আহরণের প্রযুক্তি আয়ত্ত করা গেলে পৃথিবীতে সীমিত সম্পদ নিয়ে ঐতিহাসিক সংঘাত এবং পরিবেশগত ধ্বংসের অবসান ঘটবে। এটি আমাদের সভ্যতাকে পৃথিবীর আর কোনো ক্ষতি না করেই এগিয়ে যেতে সাহায্য করবে।
ব্রায়ান কক্স নতুন যুগের চ্যালেঞ্জগুলোও তুলে ধরেছেন। মহাকাশ ক্রমেই জনবহুল হয়ে উঠছে এবং কক্ষপথে স্থান দখলের প্রতিযোগিতা বাড়ছে। স্যাটেলাইটগুলোর মধ্যে সংঘর্ষ এড়ানোর জন্য বর্তমানে কোনো সুনির্দিষ্ট নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা নেই। কক্স একটি এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোল ব্যবস্থার মতো মহাকাশ ট্রাফিক কন্ট্রোল সিস্টেমের প্রয়োজনীয়তার কথা বলেছেন, যা বিভিন্ন দেশ ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের সম্মতিতে পরিচালিত হবে।
- ট্যাগ:
- মতামত
- মহাকাশ যাত্রা
- সংকট উত্তরণ