ট্রাম্পের নতুন আতঙ্ক ‘মামদানি সিন্ড্রোম’
যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতিতে ইতিহাস সৃষ্টি করার পথে জোহরান মামদানি। বিশ্বের সবচেয়ে ধনী শহরটিতে মেয়র নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন তিনি দরিদ্র মানুষের কথা বলে। প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন কেবল শক্তিশালী প্রতিপক্ষ অ্যান্ড্রু কুমোর বিরুদ্ধে নয়, বরং বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাধর ব্যক্তি ডনাল্ড ট্রাম্প, সবচেয়ে ধনী ব্যক্তি ইলন মাস্ক ও পৃথিবীর নৃশংসতম গণহত্যাকারী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধে। আর এখন পর্যন্ত ৩৪ বছরের মামদানিই সবার চেয়ে এগিয়ে। বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে জনপ্রিয় রাজনৈতিক নেতা তিনি। তাকে ঠেকাতে হেন কোনো অপকৌশল নেই যার আশ্রয় নেয়নি ওই অশুভ চক্রটি। ট্রাম্প ও ইলন মাস্ক দুজনই কোমর বেঁধে নেমেছেন মামদানির বিরুদ্ধে।
ট্রাম্পের কাছে সিক্সটি মিনিটসের সাংবাদিক গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রী মামদানির নাম বলতেই ক্ষেপে উঠেছেন তিনি, বলছেন, “কে বলেছে সে একজন সমাজতন্ত্রী? সে একজন কমিউনিস্ট, সমাজতন্ত্রীর চেয়ে অনেক খারাপ।” যখন সাংবাদিক বললেন, “অনেকে তাকে মনে করেন আপনার বামপন্থী প্রতিরূপ।” তার হাস্যকর জবাব, “আমি তারচেয়ে দেখতে বেশি সুন্দর।” ট্রাম্প শেষ পর্যন্ত নিউ ইয়র্কবাসীদের আহ্বান করেছেন কুমোকে ভোট দেওয়ার জন্য। অ্যান্ড্রু কুমোও জানেন নিজের অযোগ্যতার কথা, তাই এখন বলছেন একজন কমিউনিস্টকে ভোট দেওয়ার চেয়ে একজন খারাপ ডেমোক্র্যাটকে ভোট দেওয়া ভালো। অবস্থা বেগতিক দেখে শেষমেষ ইলন মাস্কও মাঠে নেমেছেন, সোশ্যাল মিডিয়ায় সরাসরি ভোট চাচ্ছেন কুমোর পক্ষে। অবশেষে কুমোকে বাঁচাতে তিনি বলেছেন, কার্টিস স্লিওয়াকে ভোট দেওয়া মানে মামদানিকেই ভোট দেওয়া, কারণ ভোট হচ্ছে মামদানি ও কুমোর মাঝে, কার্টিস স্লিওয়া ধর্তব্যের মধ্যে পড়েন না।
কিন্তু রাজনীতিতে নবাগত উগান্ডায় জন্মগ্রহণকারী ভারতীয় বংশোদ্ভূত এই চোখধাঁধানো তারকা সব ক্ষমতাবানের রাতের ঘুম হারাম করে দিলেন কী করে? কারণ এই নির্ঘুম নিউ ইয়র্কের রাস্তায় রাস্তায় গভীর রাত পর্যন্ত ঘুরে বেড়িয়েছেন জোহরান মামদানি। কথা বলেছেন সেখানকার ট্যাক্সি ড্রাইভার, পরিচ্ছন্নতাকর্মী ও গৃহহীনদের সঙ্গে যারা তাদের কাঁধে বহন করে চলেছেন শহরটির বিলাসী ধনিক শ্রেণিকে। ট্রাম্পের সঙ্গে যেমন মামদানির মিল রয়েছে, তেমনি মিল আছে শহরটির বর্তমান মেয়র এরিক অ্যাডামসের সঙ্গে কেননা তিনিও রাত জেগে কাজ করে থাকেন। এরপর বের হন কোনো দামি রেস্টুরেন্টে বিলাসী খাবার খেতে ও ক্ষমতাবান ধনীদের সঙ্গে গা ঘেঁষাঘেষি করতে। অন্যদিকে মামদানি ওই শ্রেণির জন্য আতঙ্ক।
মামদানি-আতঙ্কে কাঁপছে ট্রাম্প নেতৃত্বাধীন অশুভ চক্রটি। তারা প্রচারণায় বড় করে দেখিয়েছে মামদানির দাড়ি, তার মুসলিম পরিচয়, হাত দিয়ে ভাত খাওয়ার দক্ষিণ এশীয় রীতি ইত্যাদি বিষয়। তাকে নিউ ইয়র্কের ধনীদের কাছে এক আতঙ্ক হিসেবে তুলে ধরার চেষ্টা করেছে। ইসরায়েলের পর বিশ্বে ইহুদিদের সবচেয়ে বড় বাসস্থান নিউ ইয়র্কে ফিলিস্তিন স্বাধীনতার সমর্থক মামদানিকে তুলে ধরা হয়েছে বিশ্ব জিহাদের প্রবক্তারূপে। এত ষড়যন্ত্রের পরও ইহুদি জনগোষ্ঠির দ্বারা ব্যাপকভাবে সমর্থিত তিনি। এর কারণ প্রথম থেকেই চারিত্রিক দৃঢ়তায় ভাস্বর মামদানি। ইহুদি ভোট হারানোর ভয়ে তিনি ইসরায়েলি গণহত্যার ব্যাপারে চুপ থাকেননি। বরং আরও বেশি সোচ্চার হয়েছেন। সিএনএনে দেওয়া সঙ্গে সাক্ষাৎকারে তিনি স্পষ্ট বলেছেন যে, মেয়র হওয়ার পর নেতানিয়াহু নিউ ইয়র্কে এলে তাকে আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধী হিসেবে আটক করবেন। ইলন মাস্ক এতে ক্ষিপ্ত হয়েছেন মামদানির ওপর। আর ট্রাম্প তো কমিউনিস্ট মামদানির নিউ ইয়র্কে কোনো রাষ্ট্রীয় অর্থই দেবেন না বলে ঘোষণা করে দিয়েছেন। ট্রাম্প ও মাস্ক যে বাংলা প্রবাদের মাসতুতো ভাই তা আবারও প্রমাণ দিলেন।
কিন্তু নিউ ইয়র্কের মানুষ এসব হুমকিতে আতঙ্কিত নন। ধর্ম-বর্ণ-জাতি নির্বিশেষে তারা জোহরান মামদানিকে আপনজন মনে করেন। তার এক লক্ষ স্বেচ্ছাসেবকের বিরাট বাহিনীতে রাতদিন কাজ করছেন বাঙালি অভিবাসী নারীপুরুষরাও, তারা দরজায় দরজায় কড়া নেড়ে বাংলায় বলছেন, ”তোমার মেয়র আমার মেয়র, মামদানি মামদানি।” তাকে পূর্ণ সমর্থন দিয়ে পাশে দাঁড়িয়েছেন বার্নি স্যান্ডার্স ও আলেক্সান্দ্রিয়া ওকাশিয়ো-কোর্তেজ। বার্নির প্রেসিডেন্ট নির্বাচনি প্রচারণায় অংশগ্রহণেই মামদানির রাজনৈতিক প্রশিক্ষণ এবং তার আদর্শের মশালই বহন করছেন তিনি। মামদানির প্রচারাভিযানে বার্নির সমাজতান্ত্রিক চেতনা বহমান। তার নিজের কথায়, ”২০১৬ সালে প্রেসিডেন্সির জন্য বার্নির নির্বাচনি প্রচারাভিযান আমার রাজনীতিকে ব্যাখ্যা করার গণতান্ত্রিক সমাজতান্ত্রিক ভাষা দিয়েছে আমাকে।” (জোহরান মামদানি টেকস আপ বার্নি স্যান্ডার’স টর্চ, নিক ফ্রেঞ্চ, জ্যাকোবিন, ৮ সেপ্টেম্বর ২০২৫)
২৬শে অক্টোবর কুইন্সের টেনিস স্টেডিয়ামে বার্নি ও আলেক্সান্দ্রিয়ার অংশগ্রহণে আয়োজিত সভায় মামদানি তার আসাধারণ স্মরণীয় বক্তৃতায় বলেন, ”ট্রাম্প তার অনেক দোষ সত্ত্বেও দরিদ্র মানুষের আয় বাড়ানোর ও তাদের জীবনযাত্রার ব্যয় কমানোর কথা বলেছিলেন। তবে ডনাল্ড ট্রাম্প মিথ্যা বলেছেন। যে শ্রমজীবী মানুষকে সে ধোঁকা দিয়েছে আমরা তাদের জন্য কাজ করছি।” সেখানে তিনি ঘোষণা দিয়েছিলেন, ”নিউ ইয়র্ক, আমাদের কাজ শুরু হয়েছে মাত্র। ৪ নভেম্বর আমরা হচ্ছি স্বাধীন।” তবে তা নিউ ইয়র্কবাসীর বিজয় দিবসও কিনা তা প্রমাণের অপেক্ষায়।
- ট্যাগ:
- মতামত
- সিটি মেয়র নির্বাচন