আমরা যুদ্ধের মধ্যে নেই, কিন্তু আমরা শান্তিতেও নেই। অন্য কথায়, বিশ্বের সব দেশ এখন যুদ্ধে লিপ্ত নয়, কিন্তু সব দেশের মানুষ শান্তিতে আছে, এমন কথা বলা যাবে না। শান্তিতে না থাকার একটি প্রধান কারণ কোটি কোটি মানুষের স্বাস্থ্য ঠিক নেই, স্বাস্থ্যঝুঁকি দিন দিন বাড়ছে। জার্মানির রাজধানী বার্লিনে অনুষ্ঠিত ‘বিশ্ব স্বাস্থ্য সম্মেলন ২০২৫’–এর কেন্দ্রীয় মঞ্চে অনুষ্ঠিত শেষ দিনের প্রথম অধিবেশনে এমন কথা বলা হয়। সম্মেলনের এই অধিবেশনের শিরোনাম ছিল, ‘শান্তি ও স্বাস্থ্য: বৈশ্বিক স্থিতি ও মঙ্গলের জন্য সেতুবন্ধ’।
দেড় ঘণ্টা ধরে চলা এই অধিবেশনে মূলত আলোচনা হয়েছিল রাশিয়ার আগ্রাসনের কারণে ইউক্রেনের হাসপাতাল, স্বাস্থ্যব্যবস্থা, ওষুধ সরবরাহ, শিশুদের মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যার মতো বিষয় নিয়ে। গাজায় ইসরায়েল কী করেছে, তা নিয়ে কেউ মুখ খোলেননি। শুধু বৈরুতের আমেরিকান ইউনিভার্সিটির শিক্ষক অধ্যাপক সাদি সালেহ বলেছিলেন, গাজার মানুষের জন্য এখন দরকার ‘ট্রমা কেয়ার’ ও ‘রিকনস্ট্রাক্টিভ সার্জারি’। গাজায় দ্রুত স্বাস্থ্যকেন্দ্র পুনর্গঠন করতে হবে। স্বাস্থ্যের তথ্য-উপাত্ত, নারীর স্বাস্থ্য সমস্যা অথবা অসংক্রামক রোগের ঝুঁকির মতো বিষয়গুলোর দিকে নজর দেওয়ার প্রয়োজন আছে বটে। তবে এখন তা জরুরি নয়। সাদি সালেহ জোর দিয়ে বলেছিলেন, গাজার মানুষের মানসিক স্বাস্থ্য পরিচর্যা জরুরি, আর জরুরি তাঁদের হাত, পা, মুখমণ্ডল ঠিক করা।
স্বাস্থ্যের আলোচনায় এ ধরনের অধিবেশনগুলোর শিরোনাম হয় সাধারণত ‘দ্বন্দ্ব ও স্বাস্থ্য’ (কনফ্লিক্ট অ্যান্ড হেলথ)। দ্বন্দ্বের পরিবর্তে শান্তি ব্যবহার করা হয়েছে। তবে গাজার মানুষের বিষয়ে গুরুত্ব না থাকায় অধিবেশন শেষে অনেককেই অসন্তোষ প্রকাশ করতে দেখা যায়। বিভিন্ন দেশ থেকে আসা মানুষ এতে রাজনীতির গন্ধ পেয়েছেন।
স্বাস্থ্য রাজনীতির বিষয়। ১২ থেকে ১৪ অক্টোবর, তিন দিন ধরে চলা সম্মেলনের বিভিন্ন অধিবেশনে এই রাজনীতির কথা বেশ কয়েকবার উচ্চারিত হয়েছে। সম্মেলনে একটি স্মরণিকা দেওয়া হয়। এর শিরোনাম ছিল, ‘হেলথ: এ পলিটিক্যাল চয়েজ’ (স্বাস্থ্য: একটি রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত)। তাতে বলা হয়, স্বাস্থ্য গবেষণা ও স্বাস্থ্য অবকাঠামোতে সরকার কীভাবে অর্থায়ন করবে, অপ তথ্য বা ভুল তথ্য থেকে রক্ষা করে জনগণকে সরকার কীভাবে সঠিক তথ্য দেবে—এসবই রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের বিষয়। মহামারির জন্য প্রস্তুতি অথবা জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলা, বৈজ্ঞানিক সত্য ও গণতন্ত্রকে সুরক্ষা দেওয়া রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের বিষয়। স্মরণিকায় একটি প্রবন্ধে যুক্তরাষ্ট্রের একটি গোষ্ঠীর বিজ্ঞানবিরোধী প্রচারণার বিশ্বায়ন নিয়ে তীব্র সমালোচনা রয়েছে। তবে পুরো সম্মেলনের মূল বিষয়বস্তু রাজনীতি বা স্বাস্থ্য রাজনীতি ছিল না।
ফাটল ধরা বিশ্বে স্বাস্থ্যের ভবিষ্যৎ
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা প্রতিবছর সুইজারল্যান্ডের জেনেভাতে ‘ওয়ার্ল্ড হেলথ অ্যাসেমব্লি’ বা বিশ্ব স্বাস্থ্য সম্মেলন আয়োজন করে। এই সম্মেলন মূলত সদস্যরাষ্ট্রগুলোর জন্য আয়োজন করা হয়। অনেকে মনে করেন, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার আয়োজনের বাইরে বার্লিনের এই স্বাস্থ্য সম্মেলন সবচেয়ে বড় ও গুরুত্বপূর্ণ। এবারের সম্মেলনে প্রায় চার হাজার প্রতিনিধি উপস্থিত ছিলেন। এ ছাড়া প্রায় ১০ হাজার নিবন্ধিত মানুষ অনলাইনে যুক্ত ছিলেন। সম্মেলন আয়োজনে জার্মান সরকার, গেটস ফাউন্ডেশন, ইউএনএফপিএ, ইউনিসেফ, গ্লোবাল ফান্ড, গ্যাভি, রকফেলার ফাউন্ডেশন, গুগল ফর হেলথ, ইউটিউব হেলথসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান সহায়তা করে। ওষুধ ও চিকিৎসাযন্ত্র কোম্পানিগুলোর মধ্যে আয়োজনে যুক্ত ছিল সিমেন্স, এবোট, বায়ার, রোস, জিএসকে, লিলি, নভো নরডিস্ক, ফাইজার, স্যানোফির মতো বড় বড় প্রতিষ্ঠান।
সম্মেলনে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল ছয়টি—বৈশ্বিক স্বাস্থ্য স্থাপত্যের ক্রান্তিকাল, অসংক্রামক রোগ, শান্তি ও স্বাস্থ্য, নারী ও শিশু স্বাস্থ্য, স্বাস্থ্য ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এবং স্বাস্থ্যের ওপর জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব। এই ছয় বিষয়ের ওপর ছয়টি অধিবেশন বসে সম্মেলনের কেন্দ্রীয় মঞ্চে। এই ছয় বিষয়ের সঙ্গে সম্পর্ক রেখে আরও ২৫টি প্যানেল আলোচনা ও ২০টি ওয়ার্কশপ অনুষ্ঠিত হয়। আয়োজকদের পক্ষ থেকে বলা হয়, মানুষ এখন ভুল তথ্য, ভূরাজনৈতিক উত্তেজনা, জলবায়ুর সংকট, প্রসারমান বৈষম্য, অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা এবং নতুন স্বাস্থ্যঝুঁকিতে থাকা এক জটিল ও ফাটল ধরা বিশ্বের মুখোমুখি। এ পরিস্থিতিতে স্বাস্থ্য ঠিক রাখার দায়িত্ব শুধু সরকার বা সরকারি প্রতিষ্ঠানের নয়। নাগরিক সংগঠন ও প্রাইভেট সেক্টরের এ ক্ষেত্রে সমান দায়িত্ব রয়েছে। প্রত্যেক ব্যক্তি, প্রতিটি সমাজ, প্রতিটি স্থানীয় সংস্থা, প্রতিটি দেশের সরকার এবং প্রতিটি বহুপক্ষীয় প্রতিষ্ঠানকে তাদের অবস্থান অনুযায়ী কাজ করতে হবে এবং প্রতিটি ক্ষেত্রে জবাবদিহি নিশ্চিত থাকা জরুরি।
ডোনাল্ড ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর স্বাস্থ্য খাতে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থায়নে নাটকীয় পরিবর্তন আসার পর এশিয়া ও আফ্রিকার অনেক দেশ ও প্রতিষ্ঠান সংকটে পড়েছে। বহুপক্ষীয় সহযোগিতা দুর্বল হচ্ছে, চাপের মধ্যে আছে। এরই মধ্যে বৈশ্বিক স্বাস্থ্য খাতের ক্ষমতাকাঠামোতে পরিবর্তন আসতে শুরু করেছে। পাশাপাশি বিজ্ঞানের প্রতি মানুষের বিশ্বাসে ঘুণ ধরেছে। এসবই বৈশ্বিক স্বাস্থ্যের অগ্রগতিকে ঝুঁকিতে ফেলেছে। স্বাস্থ্য সম্মেলনের প্রেসিডেন্ট এক্সেল আর প্রিসের মতে, এ পরিস্থিতিতে ঐকমত্য পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে হবে। ঐকমত্য পুনঃপ্রতিষ্ঠার অর্থ হচ্ছে গবেষণার স্বাধীনতা, বিজ্ঞান যোগাযোগের উন্নতি ও সম্মিলিত দায়িত্বশীলতার পুনর্জাগরণ।