
ভারতে ‘বাংলাদেশি ভাষা’ বিতর্ক, পুশ ইন ও প্রতিক্রিয়া
দিল্লি পুলিশ একটি চিঠিতে বাংলা ভাষাকে ‘বাংলাদেশি ভাষা’ হিসেবে উল্লেখ করায় ক্ষুব্ধ হয়েছেন ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর কথায়, ‘বাংলা ভাষাকে বাংলাদেশি ভাষা বলা কলঙ্কজনক, অপমানকর, দেশবিরোধী এবং অসাংবিধানিক কাজ। এটি ভারতের সব বাংলাভাষী মানুষকে অপমান করে। তারা আমাদের হেয় করে (চিঠিতে) এমন ভাষা ব্যবহার করতে পারে না।’
দিল্লির পুলিশ যে চিঠিতে বাংলাকে বাংলাদেশি ভাষা বলেছে, সেটি বাংলাভাষী কয়েকজনকে জোর করে বাংলাদেশে পাঠানোর উদ্দেশ্যে একটি এফআইআর তদন্তের নথি অনুবাদ-সম্পর্কিত। পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকারের দিল্লিতে যে পান্থশালা আছে, সেখানকার কর্মকর্তাদের সাহায্য চাইতেই ওই চিঠি। চিঠিটি জুলাইয়ের ২৯ তারিখের। কিন্তু তার মাসখানেক আগে থেকে মমতা বাংলাভাষী ভারতীয় নাগরিকদের বাংলাদেশি তকমা দিয়ে জোর করে বাংলাদেশে ঠেলে দেওয়ার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে আসছিলেন।
দিল্লিতে ক্ষমতাসীন বিজেপি সরকার পশ্চিমবঙ্গ ও আসামের রাজ্য বিধানসভার আসন্ন নির্বাচন সামনে রেখে সংখ্যালঘু মুসলমান বাংলাভাষীদের অবৈধ অভিবাসী হিসেবে চিহ্নিত করে যে জোরপূর্বক ঠেলে দেওয়ার কাজ শুরু করেছে, তাতে বহু ভারতীয় নাগরিক অন্যায় বাস্তুচ্যুতি ও দেশান্তরির শিকার হয়েছেন এবং হচ্ছেন।
মমতা তৃণমূল কংগ্রেসের রাজ্য সরকার বেশ কয়েকটি ঘটনায় হস্তক্ষেপ করে এ রকম জোর করে বাংলাদেশে ঠেলে দেওয়া বা পুশ ইন করা কয়েকজনকে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছে।
বাংলা যে ‘বাংলাদেশি’ ভাষা; অর্থাৎ বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় ভাষা, তা নিয়ে প্রশ্ন তোলার কোনো অবকাশ নেই। কিন্তু বহু ভাষার দেশ ভারতের পশ্চিমবঙ্গেও বাংলাই প্রধান ভাষা। আসাম, ত্রিপুরা এবং আরও কয়েকটি রাজ্যে বাংলাভাষী জনগোষ্ঠীর উল্লেখযোগ্য সংখ্যক উপস্থিতি রয়েছে। তা ছাড়া জীবিকার প্রয়োজনে আন্তরাজ্য অভিবাসনও ভারতে নিষিদ্ধ নয়। সুতরাং সব রাজ্যেই বাংলাভাষী ভারতীয় নাগরিকদের অন্যান্য নাগরিকের মতোই সম-অধিকার ভোগ করার কথা। কিন্তু বিজেপির মুসলিমবিদ্বেষী রাজনীতি মুসলমান বাংলাভাষীদের জন্য ক্রমেই ভীতিকর হয়ে উঠছে।
বাংলাভাষী মুসলমানদের বাংলাদেশি অভিহিত করার এই রাজনীতি নতুন নয়। বিজেপি ভারতে প্রথমবারের মতো যখন সরকার গঠন করে, সেই সময়েও তখনকার উপপ্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী লালকৃষ্ণ আদভানি বলতে শুরু করেন, ভারতে দুই কোটি অবৈধ বাংলাদেশি অভিবাসী রয়েছে, যাদের স্বদেশে ফেরত পাঠাতে হবে। সে সময় লন্ডনে ইন্ডিয়া হাউসের সংবাদ সম্মেলনে আমি তাঁর কাছে ওই পরিসংখ্যানের সূত্র জানতে চাইলে তিনি বলেছিলেন, তাঁর আগের সরকারের সময় থেকেই ওই সংখ্যা তাঁরা শুনে এসেছেন। কিন্তু কোনো জনশুমারি বা যাচাই-বাছাইয়ে ওই দাবির যৌক্তিকতা পাওয়া যায়নি।
ভারতে ধারাবাহিকভাবে বাংলাভাষী মুসলমানদের অবৈধ অভিবাসী অভিহিত করে হয়রানির যে ধারা চলে আসছে, তাতে অবৈধ অনুপ্রবেশের জিগির তোলার পেছনে যে রাজনীতিটা, তা স্পষ্ট। এবারেও মমতার প্রতিবাদের জবাবে বিজেপির প্রতিক্রিয়াতে ভোটের রাজনীতির প্রকট প্রতিফলন দেখা যায়।
দলটির আইটি সেলের প্রধান অমিত মালব্য বলেছেন, ‘পুলিশ বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারীদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নিচ্ছে অথচ পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী সেখানে ভাষাকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছেন। সব অবৈধ বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারী ও রোহিঙ্গাদের দেশের আইন অনুযায়ী কঠোরভাবে মোকাবিলা করা হবে। ভারতের সার্বভৌমত্ব ও জাতীয় নিরাপত্তা রক্ষার পথে কোনো রাজনৈতিক নাটক বা ভোটব্যাংকের রাজনীতি বাধা হতে পারবে না।’
এবারে মমতা অবশ্য রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের কথা তুলেছেন। মমতা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে লিখেছেন, ‘বাংলা আমাদের মাতৃভাষা, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং স্বামী বিবেকানন্দের ভাষা, যে ভাষায় আমাদের জাতীয় সংগীত এবং জাতীয় গীতি (পরবর্তীটি বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের লেখা) রচিত, যে ভাষায় কোটি কোটি ভারতীয় কথা বলেন এবং লেখেন, যে ভাষা ভারতের সংবিধান দ্বারা এবং স্বীকৃত, এখন তাকে বাংলাদেশি ভাষা হিসেবে বর্ণনা করা হয়!’
- ট্যাগ:
- মতামত
- প্রতিক্রিয়া
- বাংলা ভাষা
- পুশ ইন