
বাংলাদেশে কি নারী হওয়া অপরাধ
মুরাদনগরের ঘটনা—অন্তত যাঁরা এখনো চোখে আলো দেখতে পান, বিবেকে আঁচ পান—তাঁদের কাছে এটি একটি বিবস্ত্র সত্য। এক হিন্দু নারী, ঘর থেকে টেনে বের করে, দলবদ্ধ ধর্ষণের শিকার। তারপর তাঁর বিবস্ত্র দেহ লাঞ্ছিত করে ভিডিও তোলা হয়েছে। সেই ভিডিও ভাইরাল। তাতে শোনা যাচ্ছে তাঁর কান্না, আর দেখা যাচ্ছে লোকজন দাঁড়িয়ে দেখছে, কেউ কেউ আবার মোবাইল ফোনে ভিডিও করছে। এই মুহূর্তে আমরা এক ভয়াবহ জাতিগত অসুস্থতার মধ্যে প্রবেশ করেছি—যেখানে মানুষ আর মানুষ নেই, রাষ্ট্র আর রাষ্ট্র নেই, নারী আর নিরাপদ নেই।
এই কলাম লেখার সময়ও চোখে ভাসছে সেই ভিডিওর স্থিরচিত্র। মনে পড়ছে ওই সব নারীর কথা—কারও গায়ে কেরোসিন ঢেলে পোড়ানো হয়েছে, কেউ পুলিশি হেফাজতে ধর্ষণের শিকার হয়েছে, কেউ প্রকাশ্য রাস্তায় মার খেয়ে পড়ে ছিল, কেউ আবার ‘ধর্ষণ করার লাইভ ভিডিও’ হয়ে পরিণত হয়েছে ‘ট্রেন্ডিং’ ক্লিপে। কিন্তু আমাদের সমাজ? সে আবার ভুলে যাওয়ার প্রতিযোগিতায় বিশ্বসেরা।
‘আমি মনেপ্রাণে বাঙালি, আমার মেমোরি পুরাই গোল্ডফিশ টাইপ’—এই ব্যঙ্গই এখন বাস্তব। খবর আসে, হৃদয় বিদীর্ণ হয়, তারপর ব্যস্ত হই নতুন গানের রিলস বানাতে, কনসার্টে যেতে বা ইউনূস স্যারের মালয়েশিয়া সফরের পুরস্কারের গল্প শুনতে।
বাংলাদেশে একজন হিন্দু নারী, দরিদ্র, প্রান্তিক এবং নিরস্ত্র—এই পরিচয়গুলো যেন একেকটা টার্গেট মার্ক। কেউ তাঁর পাশে দাঁড়ালে, কেউ সাম্প্রদায়িক সহিংসতার বিরুদ্ধে মুখ খুললে, কেউ স্রেফ মানবিক হয়ে প্রতিবাদ জানালেই তাঁর গায়ে লেগে যায় ‘ভারতের দালাল’ তকমা। এই নোংরা রাজনৈতিক ঘুঁটি চালনার মধ্যে মানবিকতা কোথায় গিয়ে দাঁড়ায়?
নারীর ওপর সহিংসতা নতুন কিছু নয়, কিন্তু রাষ্ট্রীয় নির্লিপ্ততা এখন সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে গেছে। রাষ্ট্রপ্রধানের জন্মদিনে কোটি টাকার বাজেট, করপোরেট সংবাদমাধ্যমের ক্যামেরা ব্যস্ত ভিআইপি রিসিপশন কভার করতে, অথচ মুরাদনগরের সেই নারীর আর্তনাদের জন্য একটি জাতীয় পতাকাও অর্ধনমিত হয় না, কোনো দায়িত্বশীল ব্যক্তিও পদত্যাগ করেন না, এমনকি কেউ ‘দুঃখ’ প্রকাশ করতেও রাজি নয়।
ধর্মনিরপেক্ষতার মুখোশ পরে যাঁরা রাষ্ট্র চালাচ্ছেন, তাঁরা যেন এক অদ্ভুত ভারসাম্য রক্ষা করছেন—সাম্প্রদায়িকদের চুপচাপ সন্তুষ্ট রেখে এবং প্রগতিশীলদের নিঃশব্দে গলা চেপে ধরে।
এখানে আরেকটি জটিল সত্যও অনস্বীকার্য—রাজনীতি এখন আর কেবল দুর্নীতির বা ক্ষমতা দখলের খেলা নয়, এটি স্মৃতি নির্মাণ ও বিস্মৃতি তৈরির একটা নির্লজ্জ প্রক্রিয়া। আমাদের শেখানো হচ্ছে কী মনে রাখতে হবে, কী ভুলে যেতে হবে। সরকার বলছে—‘ধর্ষণের ভিডিও ভাইরাল হয়েছে? আপনারা আবেগপ্রবণ হচ্ছেন, এটি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দেখছে, আমরা তদন্ত করছি।’ অথচ প্রতিটি তদন্ত, প্রতিটি ফলোআপ, একেকটি ধূসর জাদুঘরে স্থান পায়, যেখানে বিচার নেই, পরিবর্তন নেই, কেবল থেমে থাকে সময়। তাই মুরাদনগরের ঘটনায় যাঁরা গ্রেপ্তার হয়েছেন, তাঁদের শাস্তি হবে কি না, সেই সংশয় মনে থেকে যায়।
আমরা অতীতে বিচারহীনতার সংস্কৃতির বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিলাম। পথে নেমেছিল ছাত্র, শিক্ষক, সাধারণ মানুষ। নারীর নিরাপত্তা, সংখ্যালঘুর অধিকার, রাষ্ট্রের জবাবদিহি—এসব প্রশ্ন নিয়ে গর্জে উঠেছিল বহু কণ্ঠ। কিন্তু সেসব তোয়াক্কা করা হয়নি। বরং রাষ্ট্র আমাদের বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়েছে। আন্দোলনকারীদের করা হয়েছে লাঠিপেটা, মামলা, গুম, হুমকি ও অপমান। রাষ্ট্রীয় নীরবতা তখনই সক্রিয় হয়ে ওঠে, যখন কেউ বলে—‘এটা অন্যায়’।
- ট্যাগ:
- মতামত
- নারীর প্রতি সহিংসতা