বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে এক শিক্ষককে পেয়েছিলাম, যিনি নতুন-পুরোনোনির্বিশেষে সব শিক্ষার্থীকেই ‘আপনি’ বলে সম্বোধন করতেন। নবীন শিক্ষার্থীরা ‘হোঁচট’ খেতেন, অনেকে তুমি বলার জন্য কাকুতি–মিনতি করতেন; কিন্তু স্যার কাউকে কোনো দিন তুমি বলতেন না। রিকশাচালক, কমনরুমের ফরমাশ খাটা বিনা বেতনের বয়, কলাভবনের পরিচ্ছন্নতাকর্মী—সবাইকে একই স্বরে তিনি আপনি করেই বলতেন।
এই ধাতুর আরেক বিরল ব্যক্তিত্ব ছিলেন অধ্যাপক মুহম্মদ শামসউল হক, (রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের তৃতীয় উপাচার্য, পরে মন্ত্রী। তাঁকে তাঁর একান্ত সহকারী, এমনকি পিয়ন পর্যন্ত আগে সালাম দিতে পারেননি। তিনিই আগে সালাম দিতেন এবং সবাইকে আপনি করেই সম্বোধন করতে দেরি করতেন না।
কিন্তু তাঁদের গুণমুগ্ধ বেশির ভাগ ছাত্রের মধ্যে বিষয়টি ‘সংক্রমিত’ হয়নি। আমরা জানি, অসুখ সংক্রমিত হয়, সুস্বাস্থ্য নয় আর সুবচন তো ‘হুনস্ত দুরস্ত’। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের সেই শিক্ষকের সরাসরি ছাত্র পরবর্তী সময়ে মেধার গুণে বিভাগের শিক্ষক হওয়ার পর তাঁর শিক্ষার্থীদের ‘আপনি’ দূরে থাক, ‘তুমি’ টপকিয়ে একেবারে ‘তুই’ বলে সম্বোধন শুরু করেন। তাঁর ধারণা ছিল, হাঁটুর বয়সী পোলাপানের সঙ্গে আপনি বললে মাথায় চড়ে বসবে। কন্ট্রোল করা যাবে না, আর বাইরে বলতেন, আমি ওদের ‘আপন’ ভাবি বলেই তুই বলি!
আমাদের আপনি বলা সেই শিক্ষক অথবা সবার আগে সালাম দেওয়া অধ্যাপক ড. মুহম্মদ শামসউল হককে কেউ কোনো সময় অসম্মান করেছেন বলে কোনো কানকথাও নেই। অথচ ‘তুই’ বলে যিনি আপন করে নেওয়ার নজির তৈরি করতে চেয়েছিলেন, তিনি সামনে-অসামনে শিক্ষার্থী, প্রাক্তন শিক্ষার্থীদের মাধ্যমে নানাভাবে অপমানিত হয়েছেন। পেছন থেকে ‘ভুয়া’ ধ্বনি শুনেছেন বহুবার।
সম্প্রতি (২৭ মার্চ ২০২৫) ‘তুই’ বলে সম্বোধন করায় ময়মনসিংহে সজীব (২০) নামের এক তরুণকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছে। কোতোয়ালি মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) জানিয়েছেন, ‘বড় ভাই’ ও ‘ছোট ভাই’ দ্বন্দ্বে খুন হয়েছেন সজীব। আগের দিন রাতে হামিদউদ্দিন রোডে সজীবসহ বেশ কয়েকজন তরুণ-যুবক আড্ডা দিচ্ছিলেন। এ সময় মন্টি মিয়া (২৬) নামের স্থানীয় একজনকে ‘তুই’ বলে সম্বোধন করেন সজীব। বিষয়টি নিয়ে দুজনের মধ্যে বাগ্বিতণ্ডা হয়।
একপর্যায়ে পাশের একটি দোকান থেকে সুপারি কাটার জাঁতি (সরতা) এনে ধারালো অংশ দিয়ে সজীবের বুকে কোপাতে শুরু করেন মন্টি। পরে স্থানীয় বাসিন্দারা সজীবকে উদ্ধার করে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যান। সেখানে তাঁকে মৃত ঘোষণা করেন চিকিৎসক।
দুজনের বয়সের পার্থক্য বেশি না হলেও ‘সম্মানের জন্য’ বুকে ছুরি বসাতে দেরি হয়নি। ‘তুই’ কি শুধুই তুচ্ছ অর্থে ব্যবহৃত হয়, নাকি তাঁর সঙ্গে সম্বোধনকারীর শ্রেণিদূরত্বের কথাও মনে করিয়ে দেয়। যেমন রিকশাচালক, ফেরিওয়ালা, বাজারে তরকারি বিক্রেতাকে যেভাবে পাইকারিভাবে ‘তুই’, ‘তুমি’ করি, সেখানে বয়সের কোনো মাপকাঠি থাকে না। মানুষকে ক্ষমতাহীন করে দেওয়ার এ এক চমৎকার হাতিয়ার ‘আমি উত্তম তুমি অধম’—তুই সম্বোধনের মাধ্যমে সহজেই সেই বার্তা প্রচার করা যায়।
আমলাতন্ত্রের মধ্যে এই আচরণকে পোশাকি রূপ দেওয়া হয়েছে। এক দিনের জুনিয়র হলেও তাকে আর কোনোভাবেই আপনি বলে সম্বোধন করার রেওয়াজ নেই বললেই চলে। অনেককে দেখেছি আপনি সম্বোধন ফিরে পাওয়ার জন্য কাঁচুমাচু হয়ে বলে দিতেন, ‘আমার কিন্তু এসএসসি অত সালে।’ বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এসবে বরফ গলে না; বরং উত্তর আসে, ‘ওহ তাই!’ এসব সিনিয়র-জুনিয়র দিয়ে বেঁধে দেওয়া হয় আনুষ্ঠানিক-অনানুষ্ঠানিক অনুষ্ঠানকে—আগে বসবে কে পরে বসবে।
দুই সচিব একবার একই কাফেলায় হজে গেছেন। হজের পূর্ব অভিজ্ঞতা আর মাসলা–মাসায়েল জানা-শোনার কারণে মোয়াল্লেম করা হয়েছিল তাঁদের একজনকে। যিনি মোয়াল্লেম হলেন, তাঁর প্রমোশন হয়েছিল পরে। আগে যিনি প্রমোশন পেয়েছিলেন, তিনি হজে গিয়েও পদে পদে সচিবালয়ের সম্মান-মর্যাদা আশা করতে থাকেন। একদিন বাসে বসা নিয়ে মোয়াল্লেম হতে না–পারা সচিবের তীব্র আপত্তি, বিরক্তিকর কথা-কাটাকাটিতে রূপ নেয়। আল্লাহ মালুম হাশরের ময়দানে তাঁরা কোন ‘তুমি-তুইয়ের সুতা’ ধরে বসে থাকবেন।
এ তো গেল পজিশনের ধমক; বয়সের ধমক কথায় কথায় শুনতে হয় কম বয়সীদের। তরুণ বয়সে ‘ফ্লাড অ্যাকশন প্ল্যানের’ কাজে যুক্ত হয়েছিলাম ১৯৯০ সালে। কাজ ছিল বন্যাদুর্গত অঞ্চলের মানুষের সঙ্গে কথা বলা। বন্যার সঙ্গে তাঁরা কীভাবে বসবাস করে সামাল দেন, তার তত্ত্বতালাশ করা। বন্যা দেখাশোনার দায়িত্বে থাকা সরকারি কর্মকর্তাদের কাছ থেকে কেমন তথ্য সহযোগিতা পান ইত্যাদি।