বর্তমান সময়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনার বিষয়বস্তু হচ্ছে জাতীয় সংসদ নির্বাচন। অবশ্য, অন্তর্বর্তী সরকারের অগ্রাধিকার তালিকায় যে কার্যক্রমগুলো চিহ্নিত করা হয়েছে, তার মধ্যে দেশের প্রায় ধ্বংসপ্রাপ্ত সব সংস্থা, যেমন-পুলিশ, বিজিবি, ব্যাংক/অন্যান্য আর্থিক প্রতিষ্ঠান, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, বিচার বিভাগ ইত্যাদিসহ সব সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের সংস্কার, জুলাই-আগস্ট হত্যাকাণ্ডসহ গত ১৭ বছরে সংঘটিত বিচারবহির্ভূত সব হত্যাকাণ্ড এবং নির্যাতনের জন্য দায়ী বিগত সরকার এবং প্রশাসনের সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের বিচার শুরু/সম্পন্ন করা এবং সবশেষে একটি সর্বজন গৃহীত নিরপেক্ষ, শান্তিপূর্ণ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন আয়োজনের মাধ্যমে নির্বাচিত সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করার মাধ্যমে অন্তর্বর্তী সরকারের সফল সমাপ্তি করা। সংস্কার একটি চলমান প্রক্রিয়া হওয়ায় এর ব্যাপ্তি এবং প্রকারভেদ বিবেচনায় যতদ্রুত সম্ভব সংস্কার কার্যক্রম শুরু করা দরকার। আমি মনে করি, দেশের শান্তিশৃঙ্খলা বজায় রাখতে সবার আগে প্রয়োজন স্থানীয় সরকারকে শক্তিশালী এবং জবাবদিহিমূলক করা। কারণ দুর্নীতি এবং ক্ষমতার অপব্যবহার শুরু হয় গ্রাম/ইউনিয়ন পর্যায় থেকে। সেক্ষেত্রে ‘স্থানীয় সরকার’ নির্বাচনব্যবস্থায় কেন্দ্রীয় সরকার কাঠামোর আদলে একটি স্বতন্ত্র নতুন পদ্ধতি অন্তর্ভুক্ত করা গেলে স্থানীয় পর্যায়ে ক্ষমতার ভারসাম্যসহ দুর্নীতি রোধে কার্যকর ভূমিকা রাখবে।
এতে গতানুগতিক পদ্ধতির চেয়ে নতুন ব্যবস্থা আরও শক্তিশালী ও গতিশীল হবে। তবে স্থানীয় সরকার নির্বাচনব্যবস্থার সংস্কার করতে একেবারে তৃণমূল পর্যায় থেকে শুরু করতে হবে। যেমন-গ্রাম থেকে ইউনিয়ন, ইউনিয়ন থেকে উপজেলা, এরপর জেলা থেকে জাতীয় নির্বাচন। স্বাধীনতা-পরবর্তী গতানুগতিক পদ্ধতি পরিহার করে গ্রাম থেকে জাতীয় পর্যায় পর্যন্ত নতুন পদ্ধতি অন্তর্ভুক্তির মাধ্যমে পুরো নির্বাচনব্যবস্থাকে এমনভাবে সাজাতে হবে, যাতে নির্বাচন-পরবর্তী ফলাফলকে কোনোভাবেই প্রভাবিত করার সুযোগ না থাকে। এমন একটা ব্যবস্থা প্রবর্তন করতে পারলে, সমাজে থাকবে না কোনো বৈষম্য এবং দুর্নীতি, বন্ধ হবে প্রভাব বিস্তারের প্রবণতা। এতে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবার অধিকার সংরক্ষণ করা সম্ভব হবে। আমাদের ছোটবেলায় গ্রাম সরকার পদ্ধতি চালু হয়েছিল, পরবর্তীকালে উপজেলা পদ্ধতিও চালু হয়, কিন্তু সরকারের নীতির ধারাবাহিকতার অভাবে ওই পদ্ধতির আবেদন সর্বজনীন না হওয়ায় সেটা টিকে থাকতে পারেনি। আমাদের দেশে যে প্রচলিত নির্বাচনব্যবস্থা রয়েছে, তাতে প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে ইউনিয়ন, উপজেলা থেকে জেলা, এমনকি জাতীয় পর্যায়ের নির্বাচনে স্থানীয় নেতাকর্মীদের ক্ষমতা (মাসল পাওয়ার) এবং অর্থ লেনদেনের প্রভাবমুক্ত রাখা খুবই কঠিন। এক্ষেত্রে গ্রাম থেকে জাতীয় নির্বাচন- সব ক্ষেত্রেই ব্যাপক অর্থ লেনদেন হয়। ফলে নির্বাচন-পরবর্তী সময়ে নির্বাচিত প্রতিনিধি ওই অর্থ ফিরে পেতে দুর্নীতি করতে বাধ্য হন। তাই এ ধরনের নির্বাচনব্যবস্থাকে পরিহার করে একটি নতুন পদ্ধতি অনুসরণ করা যেতে পারে। আমার ধারণা, এতে একক ক্ষমতার অবসান হবে। শুধু তাই-ই নয়, এতে ক্ষমতার ভারসাম্য রক্ষা করা সম্ভব। স্থানীয় সরকার পদ্ধতি এবং নির্বাচনব্যবস্থা নিুরূপে সংশোধন করা যেতে পারে :
প্রতিটি গ্রামে কেন্দ্রীয় সরকারের আদলে ‘গ্রাম পরিষদ সরকার’ নামে একটি সরকারব্যবস্থা প্রবর্তন করা যেতে পারে, যার প্রধান হিসাবে একজন ‘গ্রাম সরকার প্রধান’ থাকবে। ওই গ্রাম সরকার প্রধানের অধীনে ১৬ সদস্যের একটি কমিটি থাকবে (সদস্য সংখ্যা কম/বেশি হতে পারে)। এ কমিটির সব সদস্যকেই স্থানীয় নির্বাচনের মাধ্যমে নির্বাচিত হতে হবে। কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন : ১. শিক্ষা সম্পাদক, ২. ক্রীড়া সম্পাদক, ৩. পরিকল্পনা ও উন্নয়ন সম্পাদক, ৪. মহিলা ও শিশুবিষয়ক সম্পাদক, ৫. বন ও পরিবেশ সম্পাদক, ৬. অর্থ ও বাজেট সম্পাদক, ৭. ধর্ম সম্পাদক, ৮. কৃষি সম্পাদক, ৯. বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি সম্পাদক, ১০. সাংস্কৃতিক সম্পাদক, ১১. যোগাযোগ সম্পাদক, ১২. পানি সম্পাদক, ১৩. আইন ও বিচার সম্পাদক, ১৪. দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা সম্পাদক, ১৫. নির্বাহী সম্পাদক-১ (প্রথম সদস্য সচিব), ১৬. নির্বাহী সম্পাদক-২ (দ্বিতীয় সদস্য সচিব)।
গ্রাম সরকারের অনুরূপ ইউনিয়ন পরিষদ সরকার, উপজেলা পরিষদ সরকার এবং জেলা পরিষদ সরকার থাকবে। প্রত্যেক সরকারের গঠনতন্ত্রে একইসংখ্যক সদস্য থাকবে। প্রত্যেক সরকারের প্রধান হিসাবে একজন প্রধান থাকবে, যার নেতৃত্বে গঠিত কমিটি কেন্দ্রীয় সরকারের আদলে স্ব স্ব গ্রাম/ ইউনিয়ন/ উপজেলা/ জেলার সার্বিক উন্নয়নে নিজ নিজ বিভাগের বার্ষিক বাজেট প্রণয়নসহ সব বিষয়ে দায়িত্ব পালন করবেন। প্রত্যেক সম্পাদকের নিজ নিজ দায়িত্ব ও কর্তব্য সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখ থাকবে। এ ধরনের পদ্ধতিতে স্থানীয় সরকারব্যবস্থা শক্তিশালী ও জবাবদিহিতমূলক হবে, প্রান্তিক পর্যায়ে সমতার ভিত্তিতে উন্নয়ন হবে। ফলে স্থানীয় পর্যায়ের দুর্নীতি ব্যাপক হারে কমে যাবে। এছাড়াও কেন্দ্রীয় সরকার নির্বাচনেও তাদের বিশেষ ভোটিং ক্ষমতা থাকবে। যেমন-গ্রাম সরকারের প্রধানের ভোটিং ক্ষমতা ১৫, অন্যান্য সম্পাদকের ক্ষমতা ১০। ‘ইউনিয়ন পরিষদ সরকার’-এর অধীনেও ১৬ জন সম্পাদক থাকবে, যাদের ভোটিং ক্ষমতা ‘ইউনিয়ন সরকার’ প্রধানের ক্ষেত্রে ২০ এবং সম্পাদকদের ক্ষেত্রে ১৫ হতে পারে। একইভাবে উপজেলা সরকার প্রধানের ভোটিং ক্ষমতা ২৫ এবং তার সম্পাদকদের (১৬ জন) ভোটিং ক্ষমতা ২০ করা যেতে পারে, জেলা পরিষদ প্রধানের ভোটিং ক্ষমতা ৩০ এবং সম্পাদকদের (সমসংখ্যক) ২৫ করা যেতে পারে।
এ ভোটিং ক্ষমতা জাতীয় নির্বাচনের (সংসদ নির্বাচন) ভোটের সঙ্গে সন্নিবেশ করা যেতে পারে। জাতীয় নির্বাচন, বিশেষ করে সংসদ নির্বাচন সাধারণ জনগণের ভোটের মাধ্যমে হতে হবে। তবে ভোট গণনার ক্ষেত্রে সাধারণ জনগণের ভোটের ফলাফলকে ৭৫ শতাংশের মাধ্যমে গণনা করতে হবে এবং অবশিষ্ট ২৫ শতাংশ ভোট সংশ্লিষ্ট নির্বাচনি এলাকার সব গ্রাম সরকার, ইউনিয়ন সরকার, উপজেলা/জেলা পরিষদ সরকার এবং তাদের সম্পাদকদের ভোটের ফলাফলের মাধ্যমে চূড়ান্ত ফলাফল নির্ধারণ করতে হবে। এতে নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী জনপ্রতিনিধিদের একক ক্ষমতা, দম্ভ এবং প্রভাব কিছুটা হলেও খর্ব হবে; ফলে ক্ষমতার ভারসাম্য রক্ষার উপায় তৈরি হবে বলে আমি মনে করি। স্থানীয় সরকারের প্রচলিত পদ্ধতি পরিবর্তন করে গ্রাম সরকার, ইউনিয়ন পরিষদ সরকার চালু করার মাধ্যমে পর্যায়ক্রমে উপজেলা এবং পরবর্তীকালে জেলা পরিষদ সরকার নির্বাচন করে একটি সর্বজনীন সরকারব্যবস্থা গড়ে তোলা সম্ভব হতে পারে।