গত লেখাটা যাত্রা-প্যান্ডেলে বিবেকের যে গান দিয়ে শেষ করেছিলাম তা হলো : ‘পথিক আপন বুঝে চলো-ও, এ-এই বেলা’। পথিককে ব্যক্তি ও দলের কথা দূরে রেখে, দেশকে আপন বুঝতে বলেছিলাম। কারণ, দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব সংকটাপন্ন হলে রাজনীতির জেদাজেদি কোথায় যে একনিমিষে বিলীন হয়ে যাবে, ভাবার সময়ও থাকবে না। দেশ খুব খারাপ সময় পার করছে। তাই কাদা ছোড়াছুড়ি কিংবা বিভিন্ন যুক্তি দেখিয়ে নিজের দিকে ঝোল টানার মজ্জাগত অভ্যাস বাদ দিয়ে দেশের ভালো-মন্দ ভেবে সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় কি মহান রাজনীতিবিদদের হচ্ছে? এ কলামেই জাতীয় সরকার গঠন নিয়ে কমপক্ষে দুবার লিখেছি, প্রেসক্লাবে সাংবাদিক সম্মেলনও করেছি, সেখানে এদেশের অনেক বিজ্ঞজনও উপস্থিত ছিলেন, কথা বলেছেন। রাজনৈতিক দলগুলোর মতৈক্যের বিষয়েও এ কলামে লিখেছি।
দেশ দুঃশাসনের একটা আর্থ-সামাজিক নেতিবাচক প্রভাব-বলয়ে আছে, দীর্ঘ ৫২ বছর ধরে দেখছি। বিগত ১৫ বছরের নির্বিচার খুন-গুম-লুটপাট, প্রতিহিংসামূলক দুঃশাসনে এর ভয়ানক নেতিবাচক প্রভাব আমাদের সমাজে পড়েছে। শুধু রাজনৈতিক দলের ওপরেই নয়, তাদের মনমানসিকতার ওপরে; সমাজে বসবাসরত সাধারণ মানুষের ওপরেও। দেশ চাঁদাবাজি, লুটপাট, খুন-খারাবি, মিথ্যাচার ও নির্বিচার দুর্নীতির ওপর ভাসছে। এটা কেউ মুখচাপা দিতে চাইলেও ঘটনাগুলো প্রকৃতপক্ষে সত্য। দেখা চোখে, ’২৪-এর ছাত্র-জনতার বিপ্লব কিছুসংখ্যক রাজনৈতিক দলের গোমরাহির কারণে পূর্ণাঙ্গতা পেল না; বর্তমানে বিপ্লব ‘বিবাদ ও অনৈক্যের বস্তু’ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমাদের রাজনীতিকদের ব্যক্তি ও দলীয় সুবিধাবাদী চরিত্রের কারণে বিপ্লবের মাধ্যমে অর্জিত আবাদি ফসল অর্ধেকটাই পোকায় খেতে চলেছে। কোনো কোনো রাজনৈতিক দল তার মূল আদর্শ থেকে অনেকটাই দূরে সরে গেছে। ঐকমত্য কমিশনের সদস্যরা যথাসাধ্য চেষ্টা করেছেন ও এখনো করছেন। কী হতে চলেছে, মোটামুটি অনুমান করা যায়। রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের চিন্তা-চেতনা ও কর্মের সংস্কারের কথা এ কলামেই অসংখ্যবার বললেও সেকথা সংশ্লিষ্ট পক্ষের কর্ণকুহরে প্রবেশ করেছে বলে মনে হচ্ছে না, যদিও রাজনৈতিক দলের ব্যাপক সংস্কারই হওয়া উচিত আসল সংস্কার, যার অভাবে অন্যসব সংস্কারের সফলতা পূর্ণাঙ্গতা কতটুকু পাবে, প্রশ্ন থেকে যায়। রক্তচোষা-চাঁদাবাজ নেতা-কর্মীদের লোকদেখানো বহিষ্কারে সাধারণ মানুষ সন্তুষ্ট নয়। রাজনৈতিক সংগঠনের খোলনলচে বদলের সময় বয়ে যাচ্ছে। নতুন দলের কোনো কোনো সদস্যের মধ্যে অবৈধভাবে টাকা কুড়ানোর অভিযোগ ও খবরও পত্রিকায় আসছে। সব তথ্য তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। কোনো কোনো কলামে তাদের প্রথমেই রাজনৈতিক দল গঠন করার কথা নিষেধ করেছিলাম। প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজে অরাজনৈতিক সংগঠন হিসাবে সংগঠনকে মজবুত করে ধরে রাখার পরামর্শ দিয়েছিলাম এবং বিপ্লব সফল করতে ‘প্রেসার গ্রুপ’ হিসাবে সক্রিয়ভাবে কাজ করে যেতে বলেছিলাম। কার পরামর্শে তারা এমন অপরিক্বতার পরিচয় দিল, ভাবতেই অবাক লাগে। তাহলে হাজার হাজার প্রাণের আত্মাহুতি ও জীবন্মৃত অবস্থার সার্থকতা কোথায়? ছাত্র-জনতার এহেন আত্মবলি ও ত্যাগ শেষে রাজনৈতিক দলগুলোর অবিবেচনাপ্রসূত কর্মকাণ্ড দেখলে দেশটা পাশা-খেলার দান চালাচালির নিগড়ে বাঁধা পড়তে চলেছে বলে প্রতীয়মান হয়। দলবাজদের পোকায়-খাওয়া, দুর্গন্ধযুক্ত পুরোনো অবস্থান থেকে একচুলও নড়তে রাজি হতে দেখা যাচ্ছে না। হায় আত্মজিজ্ঞাসা-বিবেকবোধ, জনসাধারণের প্রতিনিধিত্ব!
অন্তর্বর্তী সরকার ভারতীয় হিন্দুত্ববাদী-আধিপত্যবাদী আগ্রাসনের উপযুক্ত জবাব, মতলববাজ ভারত কর্তৃক প্রচারিত সংখ্যালঘু নির্যাতন ও জঙ্গি তকমার কল্পিত বিদেশি চাপ, দেশের কোষাগার নিয়ন্ত্রণব্যবস্থা অনেকটা সামাল দিতে পারলেও দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা বেশ নাজুক। তাদের পজিটিভ ভূমিকা তারা সাধ্যমতো পালন করে যাচ্ছেন। সরকারপ্রধান তার ভিশনারি চিন্তাভাবনা দেশবাসীকে শোনাচ্ছেন। বাস্তবায়ন কতটুকু করতে পারছেন? অন্যদিকে অন্তর্বর্তী সরকার দেশের প্রশাসন শক্তভাবে পরিচালনা ও ইন্টারন্যাল কন্ট্রোল সিস্টেমের অস্বাভাবিক দুর্বলতা কাটিয়ে ওঠার কোনো ব্যবস্থাই নিতে পারেনি, সেটা যে কারণেই হোক না কেন। এর জন্য কোনো কোনো রাজনৈতিক দলের অনীহা ও মনে মনে অসহযোগিতা আমরা বিপ্লবের প্রথম থেকেই দেখে আসছি। অন্তর্বর্তী সরকারের টিমে অনেকে সরকারের শোভা বর্ধন করছেন, এটাও সত্য। বলতে গেলে ব্যাংকগুলোরও আর্থিক অবস্থার খোলস পড়ে আছে, বাকি সবই লুট হয়ে গেছে; মহান রাজনীতিকরা সেদিকটা একটুও বিবেচনায় আনছেন না। অনেকে ক্ষমতায় যাওয়ার প্রতিযোগিতায় বিভোর। সরকারি অফিসের উপর থেকে নিচ পর্যন্ত অকল্পনীয় বাধাহীন দুর্নীতিতে ভরে গেছে। রাজনীতির নেতা-কর্মীরাও টাকা বানানোর উৎসবে মেতেছে। পত্রিকার পাতা উলটালে ও বাস্তবে দুচোখ মেলে দেখলে সবকিছুই ধরা পড়ে। এ সবই দীর্ঘদিনের বিকৃত ও দুর্নীতি-জর্জরিত লুটপাটের রাজনীতির সামাজিক অভিঘাত। এ অভিঘাত রোখা অতটা সহজ নয়। একমাত্র দেশের জন্য ত্যাগ, সুস্থ ও সৎ রাজনীতি ও দেশাত্ববোধে উজ্জীবিত জোটবদ্ধ দৃঢ়চেতা জনগোষ্ঠী এ অবস্থা থেকে দেশকে রক্ষা করতে পারে। দুর্নীতিমুক্ত রাজনৈতিক দল, সত্যানুসারী শক্ত-সামর্থ কল্যাণকামী নেতৃত্ব, দুর্নীতিমুক্ত প্রশাসন ও বিচারব্যবস্থাই পারে এ অধঃপতিত অবস্থা থেকে দেশকে ফিরিয়ে এনে আবার নতুন বাংলাদেশ গড়তে।
অন্য কথায় আসি। এ উপমহাদেশের মারাঠা সৈন্যরা (‘বর্গি’) এ অঞ্চলে বেশ কয়েকবার আক্রমণ করেছে। এর নেতৃত্ব দেন নাগপুর রাজ্যের মারাঠা মহারাজা রঘুজি ভোঁসলে ও তার সেনাপতিরা। তারা এ অঞ্চলের গ্রামগুলোতে ব্যাপক লুটতরাজ, অগ্নিসংযোগ ও হত্যাযজ্ঞ চালায়। উদ্দেশ্য ছিল, সম্রাজ্যের বিস্তার ও ধার্যকৃত অর্থ (চৌথ) আদায়। কালক্রমে দিল্লি সাম্রাজ্যও একই উদ্দেশ্য নিয়ে আওয়ামী লীগ নামের বর্গিদের ভারতীয় দাস নিযুক্ত করে। তারা প্রভুদের নিগড়ে দেশকে পুরোপুরি বাঁধতে গিয়ে এবং এদেশ লুট করে ছাত্র-জনতার বিপ্লবে প্রভুর কোলে আশ্রয় নিয়েছে। আবারো লুট করার মওকা খুঁজছে। ‘দেশজুড়ে নাশকতার ছক আওয়ামী লীগের’ (আমার দেশ, ২৮.০৭.২৫)। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকাকালীন ভারত তার লোক দিয়ে এদেশ চালিয়েছে। ‘ডিজিএফআই কার্যালয়ে ছিল ‘র’-এর অফিস, ২ তলা ব্যবহার করে চলত ‘র’-র কার্যক্রম’ (আমার দেশ)। ‘মোসাদের’ জাল ইরানের নাগরিকদের মধ্যেও বিস্তৃত ছিল। এছাড়া ইরান ৪৭ জন ভারতীয় নাগরিককে ‘মোসাদের’ হয়ে গুপ্তচরবৃত্তির অভিযোগে অভিযুক্ত করেছে। তারা ইরানের বড় রকমের ক্ষতি করে দিয়েছে। এদেশে ‘র’-এর লোক যে আমাদের যে কোনো রাজনীতিকদের মধ্যে, বিভিন্ন বাহিনী ও কর্মকর্তাদের মধ্যে লুকিয়ে নেই, এর নিশ্চয়তা কোথায়? তারা আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে অন্তর্দ্বন্দ্ব সৃষ্টি ও অন্যান্য নাশকতামূলক কাজে জড়িত থাকতেও পারে। আমরা কি এ পর্যন্ত কোনো শুদ্ধি অভিযান পরিচালনা করেছি? ভারত সাম্রাজ্য বহুধাবিভক্ত না হওয়া পর্যন্ত এদেশ শোষণ ও হিন্দুত্ববাদী সাম্রাজ্য বিস্তারের খায়েশ বদলাবে বলে মনে হয় না। তাছাড়া অনুশোচনাহীন লোমহর্ষক খুন-গুম, গণহত্যা, পলাতক উগ্রবাদী গোষ্ঠী আবার দেশ দখলের অপতৎপরতা চালাচ্ছে। এদেশের সাধারণ মানুষ প্রভুর সহযোগিতায় বর্গিসদৃশ লুটেরাদের অপকর্ম কোনোক্রমেই আর মেনে নেবে না। কিন্তু আমাদের আত্মসচেতন হতে হবে।