
গণঅভ্যুত্থানের পর সংস্কার ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের প্রশ্ন
গণঅভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকার পতনের এক বছর পূর্ণ হয়েছে। এতে অংশগ্রহণকারীদের সমর্থনে গঠিত সরকারেরও এক বছর পূর্ণ হলো। এ দুই দিবস ঘিরে ফেলে আসা সময়টার কিছু পর্যালোচনা হয়েছে স্বভাবতই। কোন প্রেক্ষাপটে গণঅভ্যুত্থানটি হয়েছিল এবং তারপর এতে অংশগ্রহণকারী দল ও অন্তর্বর্তী সরকারের সাফল্য-ব্যর্থতার দিকগুলো আলোচিত হয়েছে। এ সময়ে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ কী ভূমিকায় ছিল, তা নিয়ে অবশ্য আলোচনা হয়েছে কম। তাদেরও তো এক বছর অতিক্রান্ত হলো। আওয়ামী লীগ নিজেও কি মূল্যায়ন করেছে ঘটনাবহুল এ সময়টার?
যাহোক, হাসিনা সরকার পতনের প্রথম বার্ষিকীতে জাতীয় নির্বাচন বিষয়ে স্পষ্ট ঘোষণা দিয়েছেন অন্তর্বর্তীকালীনসরকারের প্রধান উপদেষ্টা। মাঝে বহুল আলোচিত লন্ডন বৈঠক থেকে যে খবর মিলেছিল– দেখা যাচ্ছে, সে অনুযায়ীই নির্বাচনের ঘোষণা দিলেন তিনি। ফেব্রুয়ারিতে, রোজা শুরুর আগেই হতে যাচ্ছে প্রত্যাশিত নির্বাচন। নির্বাচন কমিশনও (ইসি) প্রধান উপদেষ্টার অফিসের চিঠি পেয়ে বলেছে, ডিসেম্বরের শুরুতেই তফসিল ঘোষিত হবে। এর আগে ভোটার তালিকা চূড়ান্ত এবং বিধিবিধান সংস্কারসহ প্রয়োজনীয় কাজ তারা সম্পন্ন করবেন। নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কারে গঠিত কমিশনের কিছু সুপারিশ রয়েছে। ‘রাজনৈতিক ঐকমত্যের ভিত্তিতে’ সেগুলো বাস্তবায়নের আবশ্যকতা অনস্বীকার্য। কিছু বিষয়ে খোদ ইসির আপত্তির খবর অবশ্য মিলেছিল। এ সবকিছুরই একটা গ্রহণযোগ্য নিষ্পত্তি করে এগোতে হবে।
সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানে আমাদের দেশে সরকারের ভূমিকা এখনও মুখ্য। তার পক্ষে প্রশাসন বিরাট ভূমিকা রাখে নির্বাচনে। তারা নিরপেক্ষভাবে কাজ করলে নির্বাচন বহুলাংশেই নিরপেক্ষ হয়। সে কারণেই কিন্তু দলীয় সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচন আয়োজনের বিরোধিতা করা হচ্ছিল। অভিজ্ঞতায়ও দেখা গেছে, কোনো দলীয় সরকারের অধীনে ‘গ্রহণযোগ্য নির্বাচন’ হয়নি। এ ধরনের প্রতিটি নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দল জিতেছে। অন্যদিকে, নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত কোনো নির্বাচনে সদ্য ক্ষমতা ছেড়ে যাওয়া দল জিততে পারেনি। আগামী নির্বাচন সে ধরনের একটি সরকারের অধীনে হতে যাচ্ছে বলেই আশা, নির্বাচন গ্রহণযোগ্য হবে। সরকারও বলছে, কখনও হয়নি– এমন একটি ‘সুন্দর নির্বাচন’ই তারা করবেন।
ইতোমধ্যে এটা অবশ্য স্পষ্ট, ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ নির্বাচনে অংশ নিতে পারছে না। তাদের ‘কার্যক্রম’ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। আওয়ামী লীগের অভিযুক্ত নেতা-কর্মীদের সঙ্গে দলটিও বিচারের সম্মুখীন। এর নিষ্পত্তি হওয়ার আগ পর্যন্ত আওয়ামী লীগ নির্বাচনে অংশ নিতে পারবে না। অংশগ্রহণের সুযোগ থাকলেও দলটি এতে অংশ নিতো বলে মনে হয় না। ক্ষমতাচ্যুতির পর গোটা পরিবেশ তার প্রতিকূলে। দেশে তারা কার্যত অনুপস্থিত। পলাতক বললেও ভুল হবে না। সম্ভাব্য এ পরিণতির কথা অনেকে মনে করিয়ে দিতে চাইলেও তারা এর পরোয়া করতেন না। এখন সে অভিজ্ঞতাই মোকাবিলা করতে হচ্ছে। তারপরও দলের কোনো পর্যায় থেকে আত্মসমালোচনা ও আত্মোপলব্ধির দেখা মিলছে না। অনুশোচনা অনুপস্থিত। থেকে থেকে গণঅভ্যুত্থানকারীদের ওপর প্রতিশোধ গ্রহণের কথাই কেবল বলা হচ্ছে।
গণঅভ্যুত্থানকারীদের একাংশ, এমনকি অন্তর্বর্তী সরকারের ভেতর থেকে কিন্তু বলা হচ্ছিল, আওয়ামী লীগ চাইলে (শর্তসাপেক্ষে) নির্বাচনে অংশ নিতে পারে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় থেকেও কোনো রাজনৈতিক দলকে নিষিদ্ধ না করার ওপর জোর দেওয়া হচ্ছিল। তবে সে পরিস্থিতি মাঝে বদলে যায় দৃশ্যত জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) বিক্ষোভের মুখে। এতে জামায়াতে ইসলামীসহ সমমনা দলগুলোর অংশগ্রহণ ছিল। সরকারও আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধ করে। এ অবস্থায় এখানে-ওখানে বের করা দলটির ‘ঝটিকা মিছিল’ও বেআইনি বলে বিবেচিত হবে। এগুলো করে কিন্তু কোনো ফায়দা হয়নি তাদের। দেশে থাকা নেতা-কর্মীরা এতে বরং অহেতুক আক্রান্ত হয়েছেন। এ অবস্থায় অনলাইনে তাদের তৎপরতা আরও বেড়েছে। সেখানে ভারতে অবস্থানকারী দলটির সভানেত্রীকেও যোগ দিতে দেখা যাচ্ছে। সবশেষে জানা গেল, তারা একটা ‘অফিস’ খুলেছেন কলকাতায়।
এদিকে গণঅভ্যুত্থান ও অন্তর্বর্তী সরকারের এক বছর ঠিকই পূর্ণ হয়ে গেল। হাসিনা সরকারের পতন-পরবর্তী পরিস্থিতি যত জটিলই হোক, মাঠে থাকা রাজনৈতিক দল ও সরকার তা মোকাবিলায় একেবারে ব্যর্থ হয়নি। গণঅভ্যুত্থানের পর অন্য অনেক দেশে পরিস্থিতি এর চাইতেও খারাপ হতে দেখা গেছে, যা পরিবর্তনকামীদের জন্য ছিল আঘাতস্বরূপ। ‘আরব বসন্তে’র অভিজ্ঞতার কথা এখানে বলা যায়। শ্রীলঙ্কায় অবশ্য বাংলাদেশের চেয়ে শান্তিপূর্ণভাবে গণতন্ত্রে উত্তরণ ঘটানো গেছে। সেখানে কিন্তু একটা নির্বাচিত সরকারই ক্ষমতায় ছিল। আর বাংলাদেশে ছিল তিন-তিনটি অগ্রহণযোগ্য নির্বাচনে ক্ষমতা কুক্ষিগত করা সরকার, যারা নজিরবিহীন দুর্নীতির জন্যও অভিযুক্ত। তাকে হটাতে প্রচলিত ধারার আন্দোলন ব্যর্থ হওয়ার এক পর্যায়ে নতুন ধরনের নেতৃত্বে ঘটে গণঅভ্যুত্থান। অনেক রক্তক্ষয় করেও সরকার তা দমনে ব্যর্থ হলে বাধ্য হয় ক্ষমতা ছাড়তে। এভাবে ক্ষমতা হারানোর ঘটনা কমই রয়েছে। এ অবস্থায় আসা যে কোনো সরকারের পক্ষেই সুষ্ঠুভাবে দেশ পরিচালনা কঠিন। গণঅভ্যুত্থানকারীদের ঐক্য বেশিদিন ধরে রাখাও কঠিন, বিশেষত যখন তাদের মধ্যে আদর্শগত মতপার্থক্য রয়েছে। গণঅভ্যুত্থানের পর এ দুটি দিকই স্পষ্টভাবে পরিলক্ষিত।