বাংলাদেশে সচরাচর যেমনটি হয়, জুলাই অভ্যুত্থানের বর্ষপূর্তিতেও তেমনটিই হয়েছে। ব্যাপক প্রচার-প্রচারণার ডামাডোলে মুষ্টিমেয় সারগর্ভ মূল্যায়ন চাপা পড়েছে এন্তার স্তুতিমূলক আলোচনার চাপে। অভ্যুত্থানকে প্রশংসায় ভাসিয়ে দিতে গিয়ে বস্তুনিষ্ঠ পর্যালোচনার জায়গাটির ক্ষতি করা হয়েছে। পরিস্থিতি এমন হয়েছে, যারা অভ্যুত্থানের বিরোধী ও ফ্যাসিবাদের দোসর ছিলেন, তাদেরও কেউ কেউ জুলাই অভ্যুত্থানের বন্দনায় পঞ্চমুখ হয়েছে। এমন দলবদলকারী ও স্তাবকের তালিকায় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন সাবেক ভাইস চ্যান্সেলরও রয়েছেন।
অথচ চাটুকারিতার বদলে জুলাই অভ্যুত্থানের গতি-প্রকৃতি, রাজনৈতিক প্রতিরোধের শক্তি, অর্জন ও ভবিষ্যতের শিক্ষা নিয়ে নৈর্ব্যক্তিক আলাপ-আলোচনা ও বিশ্লেষণই জরুরি। জরুরি জুলাই অভ্যুত্থানের সমান্তরালে বাংলাদেশের সংস্কার প্রচেষ্টা এবং গণতান্ত্রিক উত্তরণের তুলনামূলক আলোচনা। চাটুকারিতা ও মিথ্যা প্রশংসা না করে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় জুলাই অভ্যুত্থানের সাফল্য ও ব্যর্থতার বিষয়গুলো সামনে এনে ভবিষ্যতের জন্য শিক্ষা গ্রহণ করাই বরং গুরুত্বপূর্ণ।
আমাদের স্মরণ থাকা স্বাভাবিক, মাত্র এক বছর আগে, ২০২৪ সালের জুলাই মাসে বাংলাদেশের বিখ্যাত বর্ষা ঋতু ভারী বৃষ্টিতে ঢাকার রাস্তাগুলো ভিজিয়ে দিচ্ছিল। আকাশের সমান্তরালে মাটিতে তখন আরেক ধরনের ঝড় তৈরি হচ্ছিল। একটি ছোট্ট বিক্ষোভ থেকে একটি গণআন্দোলনের ঝড় ক্রমশ ধেয়ে আসছিল সমগ্র বাংলাদেশজুড়ে; আর এ আন্দোলনের মধ্যে ছিল প্রচণ্ড দ্রোহ, ক্ষোভ আর বাংলাদেশের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎকে আমূল বদলে দেওয়ার স্পৃহায় ভরপুর অভ্যুত্থানের শক্তিমত্তা।
সরকারি চাকরিক্ষেত্রে বৈষম্যের বিরোধিতা, বিশেষত কোটা সংস্কারের দাবিতে শুরু হওয়া একটি ছাত্র আন্দোলন অল্প সময়েই এক গণবিপ্লবে পরিণত হয় অনেক কারণে। তার মধ্যে যেমন ছিল আন্দোলনকারীদের প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ, তেমনিভাবে ছিল আন্দোলন দমনে শক্তি প্রয়োগ ও ভুল পদক্ষেপের প্রতিক্রিয়ায় ব্যাপক আকারে ক্ষোভের প্রকাশ। আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক শক্তিগুলো জুলাই ২০২৪ সালের ঘটনাপ্রবাহে নীরব ও নিষ্ক্রিয় ছিল, এমনটা হলফ করে বলা যাবে না। সবকিছুর সম্মিলিত ফলাফল হলো এই, দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে দীর্ঘস্থায়ী একনায়কতন্ত্রের পতন ঘটে চরম নাটকীয়তায় ভরা টানটান উত্তেজনাকর ঘটনাবলির মাধ্যমে।
এক বছর পরে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক গবেষণা, বই ও বিশ্লেষণে উঠে আসছে-এ আন্দোলন কীভাবে সফল হলো এবং কেন এটি ব্যতিক্রমী ছিল। বিশ্লেষণ বলছে, এ ছাত্র আন্দোলন শুধু রাজনৈতিক ঘটনা নয়; এটি একটি নতুন ধারা, যা তরুণদের নেতৃত্ব, ডিজিটাল প্রতিরোধ এবং গণতান্ত্রিক সংগ্রামের নতুন রূপরেখা তৈরি করেছে। গবেষক ও বিশ্লেষকরা এখন এটিকে একুশ শতকের রাজনৈতিক প্রতিরোধের এক মডেল হিসাবে দেখছেন। দেখছেন, রাজনৈতিক সংগ্রামের পথে অতীত থেকে শিক্ষা নিয়ে ভবিষ্যতের জন্য কৌশল নির্ধারণের পন্থা হিসাবে।
সাংবাদিক ও গবেষক অনুপম দেবাশীষ রায়ের লেখা ‘বিদ্রোহ থেকে বিপ্লব’ বইটিতে ২০১৮ সালের ব্যর্থ নিরাপদ সড়ক আন্দোলন ও ২০২৪ সালের সফল ছাত্র অভ্যুত্থানের তুলনামূলক বিশ্লেষণ রয়েছে। তার মতে, এ আন্দোলনের সাফল্যের মূল চাবিকাঠি ছিল স্মার্ট কৌশল, স্পষ্ট ভাষা, এবং সামাজিক মাধ্যমে সুসংগঠিত প্রচার। যখন এক মন্ত্রী ছাত্রদের ‘রাজাকার’ বলে আখ্যা দেন, তখন তা আন্দোলনের জন্য পরিণত হয় একটি নৈতিক যুদ্ধ ঘোষণায়। ছাত্ররা ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের মূল্যবোধকে হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করে সরকারকে নৈতিকভাবে চ্যালেঞ্জ করে।