বাংলাদেশের রাজনীতিতে ১৯৭১ কেবল অতীতের যে কোনো একটি বছর নয়—এটি স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্মের বছর, নৈতিক বৈধতার উৎস, আন্তর্জাতিক পরিচয়ের ভিত্তি। মুক্তিযুদ্ধ আমাদের জাতীয় চেতনার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়, যার প্রভাব পাঁচ দশক পেরিয়েও রাজনীতির প্রতিটি মোড়ে অনুভূত হয়। কিন্তু ইতিহাসের সবচেয়ে উজ্জ্বল ওই মুহূর্ত নিয়ে বিতর্কও কখনো থামেনি। কেউ এটিকে একচ্ছত্র সম্পত্তির মতো আঁকড়ে ধরেছে, কেউ আবার রাজনৈতিক সুবিধা অনুযায়ী পাশ কাটিয়েছে বা পুনর্লিখন করেছে। আর এখন দেখা যাচ্ছে, কেউ কেউ একাত্তরের রাজনীতিকে অতিক্রম করে নতুন এক সময়বিন্দু, ‘চব্বিশ’-কে জাতীয় রাজনীতির নতুন ভিত্তি হিসেবে দাঁড় করাতে চাইছে।
এই প্রেক্ষাপটে জাতীয় নাগরিক পার্টির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলামের সর্বশেষ বক্তব্য বিশেষ মনোযোগের দাবি রাখে। তিনি তার ভেরিফায়েড ফেইসবুক অ্যাকাউন্টে ইংরেজিতে একটি স্ট্যাটাস লিখেছেন যার বাংলা করলে দাঁড়ায়, “আমরা একাত্তরকে অতিক্রম করেছি এবং চব্বিশে পৌঁছেছি। একাত্তরের পক্ষে না বিপক্ষে—এই বাইনারির ওপর ভিত্তি করে তৈরি রাজনীতিকে গ্রহণ করতে কেউ আগ্রহী নয়। যারা এখনো এই পুরোনো রাজনীতিকে ফিরিয়ে আনতে চায়, তারা দেশকে একটি সেকেলে রাজনৈতিক কাঠামোতে ফিরিয়ে নিতে চায়।” তিনি আরও লিখেছন, “চব্বিশ হচ্ছে একাত্তরের ধারাবাহিকতা। একাত্তরের আকাঙ্ক্ষা সাম্য, মর্যাদা ও ন্যায়বিচার—এগুলোই চব্বিশের বৈষম্যবিরোধী এবং গণতান্ত্রিক গণ–অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে পুনরায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।”
তবে তার বক্তব্য এখানেই থামেনি। তিনি সরাসরি ‘মুজিববাদ’ প্রসঙ্গ টেনে লিখেছেন, “মুজিববাদ একাত্তরকে একটি ভারতীয় বয়ানের মধ্যে ঢুকিয়ে আমাদের জাতীয় সার্বভৌমত্ব ও স্বার্থকে বিপন্ন করেছিল, সেখানে চব্বিশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব ও মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত চেতনাকে পুনরুদ্ধার করেছে।” এই ব্যাখ্যা রাজনৈতিক দিক থেকে অত্যন্ত জটিল, কারণ একদিকে এটি মুক্তিযুদ্ধের প্রচলিত ব্যাখ্যার চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিচ্ছে, অন্যদিকে একটি নতুন প্রজন্মকে পুরোনো বিতর্ক থেকে সরিয়ে আনার চেষ্টা করছে। কিন্তু প্রশ্ন উঠছে, এমন ‘অতিক্রমের’ বক্তব্য কতটা রাজনৈতিকভাবে টেকসই?
প্রথমেই মনে রাখতে হবে, একাত্তরের বৈধতা ও গুরুত্ব শুধু রাজনৈতিক রেটরিক নয়, এটি সাংবিধানিক স্বীকৃত। ১৯৭২ সালের সংবিধান এবং বিশেষ করে ২০১১ সালের পঞ্চদশ সংশোধনীর পর শেখ মুজিবুর রহমানকে ‘জাতির পিতা’ হিসেবে ঘোষণা শুধু রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নয়, আইনি সত্য। আদালতের রায়েও এটি বহাল আছে। অর্থাৎ আপনি একে ব্যক্তিগতভাবে মানতে না-ই পারেন, কিন্তু আইন পরিবর্তন ছাড়া রাষ্ট্রীয় নথি থেকে তা মুছে ফেলা সম্ভব নয়। ফলে নাহিদ ইসলাম বা অন্য কেউ একাত্তরকে ‘অতিক্রম’ করার কথা বললে, সেটি আইনগত অর্থে নয়, কেবল রাজনৈতিক অর্থে বোঝা যেতে পারে।
আরেকটি দিক হলো ‘মুজিববাদ’। শেখ মুজিব নিজে কখনো তার রাজনৈতিক দর্শনকে ‘মুজিববাদ’ নামে অভিহিত করেননি। এই শব্দটির জনপ্রিয়তা শুরু হয় স্বাধীনতার পর, বিশেষ করে ১৯৭৩ থেকে ১৯৭৫ সালের মধ্যে, যখন জাতীয় চার মূলনীতিকে দলীয় প্রশিক্ষণ ও প্রচারে ‘মুজিববাদ’ নামে সংহত করা হয়। এটি ছিল মূলত রাজনৈতিক পরিচয় গঠনের একটি প্রচেষ্টা। কিন্তু এটা কয়েকজন ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর আলোচনা বা ব্যবহারে থাকলেও, জনপরিসরে খুব সামনে আসেনি। আওয়ামী লীগ কিংবা তৎকালীন সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে মুজিববাদ নিয়ে উচ্চাবাচ্য করেনি। অতিউৎসাহী কেউ ‘মুজিববাদ’ নামে ঢাউস বই লিখেও দেশবাসীর কাছ থেকে তেমন সাড়া পাননি।
মানুষ শেখ মুজিবকে পছন্দ করলেও মুজিববাদ নিয়ে মাতামাতির তেমন কোনো প্রমাণ নেই। ১৫ অগাস্ট ১৯৭৫-এ শেখ মুজিবকে নৃশংসভাবে হত্যার পর রাজনৈতিক ক্ষমতার পালাবদলের পর তো এই শব্দটি কোনো মহল থেকে উচ্চারিত হতে শোনা যায়নি, এমনকি আওয়ামী লীগের তরফ থেকেও নয়। পঁচাত্তর-পরবর্তী শাসকেরা ভিন্ন আদর্শগত কাঠামো দাঁড় করান, যেমন জিয়াউর রহমানের ‘বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ’ বা এরশাদের রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম ঘোষণা।
নাহিদ ইসলাম ‘মুজিববাদ’ শব্দটিকে একপ্রকার হুমকি হিসেবে চিত্রিত করছেন—যেন এটি জাতীয় সার্বভৌমত্বের বিপরীতে দাঁড়ানো একটি ভারত-ঘেঁষা মতাদর্শ। এই অবস্থান একদিকে মুক্তিযুদ্ধের আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটকে সরলীকৃত করে, অন্যদিকে দেশীয় রাজনৈতিক বিভাজনকে নতুন করে উসকে দেয়।
এখন আসা যাক নাহিদের ‘একাত্তর বনাম চব্বিশ’ বাইনারি প্রসঙ্গে। রাজনৈতিক তত্ত্বে বাইনারি মানে দ্বিমুখী কাঠামো, যেখানে আপনাকে হয় একদিকে থাকতে হবে, নয়তো বিপরীতে। বাংলাদেশের রাজনীতিতে দীর্ঘদিন ধরে ‘মুক্তিযুদ্ধপন্থী’ বনাম ‘বিরোধী’ বাইনারি কাজ করেছে। এটি কখনো কখনো ভিন্নমত দমনের হাতিয়ার হিসেবেও ব্যবহৃত হয়েছে। নাহিদ ইসলাম এই কাঠামো ভাঙতে চান এবং ‘চব্বিশ’কে ঐক্য, পুনর্মিলন ও নতুন সূচনার প্রতীক হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে চান। কিন্তু ইতিহাসকে ‘অতিক্রম’ করা সম্ভব নয়; এর প্রভাব পুনর্নির্মাণ করা যায়।
একাত্তর শুধু ইতিহাস নয়, রাষ্ট্রীয় নীতি ও পরিচয়ের অংশ। এটি বাদ দিলে আন্তর্জাতিক কূটনীতিতেও প্রভাব পড়তে পারে। ভারত, রাশিয়া, যুক্তরাষ্ট্র—সবাই বাংলাদেশের জন্মকথা হিসেবে একাত্তরকে স্বীকৃতি দিয়েছে এবং ওই স্মৃতি এখনও কূটনৈতিক আলোচনায় ব্যবহৃত হয়।