
সংস্কারে ঐকমত্যের ফানুস
সংস্কার কমিশনগুলোর সুপারিশ বিবেচনা ও গ্রহণের লক্ষ্যে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারপ্রধান ও ছয়টি কমিশনের প্রধানগণের সমন্বয়ে ‘জাতীয় ঐকমত্য কমিশন’ গঠন করা হয়েছে। এ ঐকমত্য কমিশন আগামী নির্বাচন সামনে রেখে নির্বাচনব্যবস্থা, পুলিশ বিভাগ, বিচার বিভাগ, জনপ্রশাসন, সংবিধান ও দুর্নীতি দমন বিষয়ে সংস্কারের জন্য গঠিত কমিশনগুলোর সুপারিশ বিবেচনা ও গ্রহণের লক্ষ্যে জাতীয় ঐকমত্য গঠনের জন্য রাজনৈতিক দল ও শক্তির সঙ্গে আলোচনা করে সুপারিশ করবে। ঐকমত্য কমিশন এরই মধ্যে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা শুরু করেছে।
কমিশনগুলোর প্রতিবেদন সাধারণ পর্যালোচনায় মনে হচ্ছে, কতিপয় ক্ষেত্রে একই বিষয়ে ভিন্ন ভিন্ন কমিশন ভিন্ন ভিন্ন সুপারিশ করেছে। কমিশনগুলোর মধ্যে সমন্বয়হীনতার কারণেই এমনটা হয়েছে বলে মনে হয়। এছাড়াও কমিশনগুলোর কতিপয় সুপারিশেও রয়েছে অস্পষ্টতা, অসংগতি এবং বাস্তবায়ন অযোগ্যতা। এক কমিশনের সুপারিশের সঙ্গে অন্য কমিশনের সুপারিশ অসামঞ্জস্যপূর্ণ হওয়ায় এবং কোনো কোনো কমিশনের সুপারিশে অস্পষ্টতা ও অসংগতি থাকায় তা বাস্তবায়ন পর্যায়ে জটিলতার সৃষ্টি করতে পারে। এছাড়া এসব অস্পষ্টতা এবং অসংগতি ও অসামঞ্জস্যপূর্ণ সুপারিশ রাজনৈতিক দল বা শক্তিগুলোর সঙ্গে ঐকমত্য সৃষ্টিতে অন্তরায় হতে পারে।
সংস্কার প্রস্তাব বাস্তবায়নের জন্য রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে ঐকমত্যের কোনো বিকল্প নেই। এরূপ অবস্থায় ঐকমত্য কমিশনের উচিত হবে, সব কমিশনের সুপারিশগুলো একত্রে পর্যালোচনাপূর্বক যেসব সুপারিশ অসামঞ্জস্যপূর্ণ এবং যেসব সুপারিশে অস্পষ্টতা ও অসংগতি রয়েছে, তা দূর করা। এছাড়া বাস্তবায়নে জটিলতা সৃষ্টি করতে পারে, এমন সুপারিশগুলো বাদ দেওয়া বা পরিবর্তন করা এবং রাষ্ট্রের ও জনস্বার্থের অনুকূল সুপারিশগুলো বাছাই করে বাছাইকৃত সুপারিশ বিষয়ে রাজনৈতিক দল ও শক্তিগুলোর প্রতি ঐকমত্যের আহ্বান জানানো।
কমিশনগুলোর সুপারিশের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অসংগতি ও অসামঞ্জস্য রয়েছে প্রাদেশিক শাসনব্যবস্থা চালুর সুপারিশ বিষয়ে। জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন দেশের পুরোনো চারটি বিভাগকে চারটি প্রদেশ এবং রাজধানী ঢাকাকে কেন্দ্রশাসিত এলাকা হিসাবে বিভক্ত করে প্রাদেশিক শাসনব্যবস্থা চালুর সুপারিশ করেছে। সুপারিশটি অনেকটা অসম্পূর্ণ ও দায়সারা সুপারিশ বলে মনে হয়েছে। এ প্রাদেশিক শাসনব্যবস্থা ভারত, পাকিস্তান, যুক্তরাজ্য, কানাডা বা অন্য কোনো দেশের মডেলের হবে, নাকি সম্পূর্ণ নতুন ধরনের একটা মডেল হবে, সে সম্পর্কে সুপারিশে কোনো ধারণা দেওয়া হয়নি। বিদ্যমান শাসনব্যবস্থা এবং প্রাদেশিক শাসনব্যবস্থার মধ্যে রাষ্ট্রীয়, সাংবিধানিক এবং প্রশাসনিক কাঠামোগত বিস্তর ফারাক রয়েছে। প্রাদেশিক শাসনব্যবস্থা চালুর জন্য সংবিধানে গুরুত্বপূর্ণ মৌলিক পরিবর্তন আনার প্রয়োজন হবে। এ ছাড়াও কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক সরকারের কাঠামো, প্রশাসনিক ব্যবস্থা, নির্বাচন ব্যবস্থা, পুলিশিব্যবস্থা, বিচারব্যবস্থা ঢেলে সাজানোর প্রয়োজন হবে। কিন্তু অন্যান্য কমিশন তাদের সুপারিশ বিদ্যমান শাসনব্যবস্থার আদলে করেছে। এ অবস্থায় জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের প্রাদেশিক শাসনব্যবস্থা চালুর সুপারিশ গ্রহণ করা হলে সংবিধান সংস্কার কমিশন, পুলিশ সংস্কার কমিশন, নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশন, বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশনের সুপারিশে গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন আনতে হবে। এমনকি জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের অন্যান্য সুপারিশেও পরিবর্তন আনতে হবে। এছাড়া সংবিধান সংস্কার কমিশন দেশের সব বিভাগে হাইকোর্টের স্থায়ী আসন প্রবর্তনের সুপারিশ করেছে। কিন্তু প্রাদেশিক শাসনব্যবস্থায় প্রত্যেক প্রদেশে হাইকোর্টের স্থায়ী আসন প্রবর্তনের প্রয়োজন হবে। এ অবস্থায় ঐকমত্য কমিশন কোন ধরনের শাসনব্যবস্থা চায়, তা স্থির না করে এবং প্রয়োজনে তদনুযায়ী সব কমিশনের সুপারিশে সামঞ্জস্যবিধান না করে রাজনৈতিক দল ও শক্তিকে ঐকমত্যের আহ্বান জানানো কতটা ফলপ্রসূ হবে, তা ভেবে দেখা উচিত। এছাড়া পরস্পরবিরোধী সুপারিশের কারণে রাজনৈতিক দলগুলোরও বিভ্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকবে, যা ঐকমত্যে পৌঁছতে বাধার সৃষ্টি করতে পারে।
- ট্যাগ:
- মতামত
- সুপারিশ
- কমিশন
- রাষ্ট্র সংস্কার