
ছন্দপতনের বইমেলাতেও আনন্দ
বইমেলা এখন জমজমাট। প্রতিদিন বেশ লোকজন আসছেন। আর আসছে নতুন বইও। ফাল্গুনের আগমনে বসন্ত বাতাসের ছোঁয়ায়, বইমেলার পরিবেশ যতটা আনন্দঘন হয়ে উঠতে পারত, তা হয়নি।
ছয় বছর পর দেশে ফিরে, কয়েকদিন বইমেলায় গিয়ে এমনটাই দেখে-শুনে এসেছি। যারা দেশে থাকেন, বইমেলা শুরু হলে নিয়মিত মেলায় যান, এমন কারো কারো সঙ্গে আলাপে মনে হয়েছে, আমার কাছে যতটা মনে হয়েছে, এবারের মেলাটায় তার চেয়ে বেশি ছন্দপতনের ঘটনা ঘটেছে।
ছন্দপতনের ঘটনাগুলো মেলা শুরুর আগে থেকেই হচ্ছে, স্টল বরাদ্দ নিয়ে। অন্যপ্রকাশ, আগামী প্রকাশনীসহ অনেকদিন ধরে বইমেলাকে জমিয়ে রেখেছে, এমন অনেক প্রকাশনাকে প্যাভিলিয়ন বরাদ্দ দেওয়া নিয়ে গড়িমসি করা হচ্ছিল।অন্যপ্রকাশের কথা বিশেষ করে বলার কারণ, ওদের স্টল বরাদ্দ নিয়ে টানাটানি ঘটনাটি আমার একটু ভালো করে জানা আছে। কারণ এই প্রকাশনা সংস্থাটি থেকেই এবার আমার একটি গল্পের বই ‘বেচু সরদারের ট্রুথ কমিশন’ প্রকাশ হয়েছে। শুরুতে অন্যপ্রকাশকে প্যাভিলিয়ন দেয়া হলেও আকারটি ছোট করে দেওয়া হয়েছিল।পরে অবশ্য প্রমাণ সাইজের প্যাভিলিয়নই দেওয়া হয়েছে।
আরও কয়েকজন স্বনামধন্য প্রকাশক, যারা প্যাভিলিয়ন পেতেন প্রতিবছর, তাদেরকে বরাদ্দ করা হলো স্টল। প্যাভিলিয়নের পরিবর্তে স্টল বরাদ্দের কারণ হিসেবে দেওয়া হলো ‘দোসর’ ট্যাগ। এই ট্যাগিংয়ের রাজনীতিটা বাংলাদেশে বেশ পুরোনো।তবে বিগত আওয়ামী লীগ আমলে সেটা বাড়াবাড়ি পর্যায়ে পৌঁছায় এবং গণ-অভ্যুত্থানের পর তা আবার ভিন্নমাত্রা পেয়েছে। উদার-অসাম্প্রদায়িক রাজনীতিতে বিশ্বাসী কেউ স্বৈরাচারে পরিণত হওয়া আওয়ামী সরকারের এক-আধটু সমালোচনা করলেই সেই সময় ‘জামাত-শিবির’ বলে ট্যাগিং করা হতো। জুলাই অভ্যুত্থানের অর্ধবার্ষিক হতে না হতেই নতুন ট্যাগ আবিষ্কৃত হলো ‘স্বৈরাচারের দোসর’। বইমেলায়ও দেখা গেল প্রকাশকদের কাউকে কাউকে ‘স্বৈরাচারের দোসর’ ট্যাগ দিয়ে প্রাপ্য পরিসর অর্থাৎ যার প্যাভিলিয়ন পাওয়ার কথা তাকে দেওয়া হয়েছে স্টল। দেনদরবারের পর প্যাভিলিয়ন পেলেও পাননি কাঙ্ক্ষিত পরিসর। ফলে পার্ল পাবলিকেশন্সের মতো দুয়েকটি প্রকাশনা সংস্থা মেলা বর্জন করেছে।
মেলা বর্জনের, এমন কী মেলায় স্টল বরাদ্দ না দেওয়ার সংস্কৃতিও নতুন নয় বলে জানতে পারলাম। বিগত বইমেলাতেই স্টল বরাদ্দ পায়নি আদর্শ বলে একটি প্রকাশনী সংস্থা– যে প্রকাশনাটি বিগত আওয়ামী লীগ সরকারবিরোধীদের বই প্রকাশ করেছিল সাহস করে। এবার দেখা গেল তসলিমা নাসরিনের কবিতার বই বের করায় ‘সব্যসাচী’ নামে একটি প্রকাশনা সংস্থার স্টল বন্ধ করে দেওয়া হলো। ‘উজান’ নামে অন্য একটি প্রকাশনা সংস্থা ভয়ে স্টল বন্ধ রেখেছে। উজান থেকে ২০২৪ সালে প্রকাশিত সোহেল হাসান গালিবের একটি কবিতার বই নিয়ে ব্যাপক নিন্দামন্দ করা হচ্ছে। কবিকে এরই মধ্যে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, পুলিশি হেফাজতে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদও করা হয়েছে। সরকারি কলেজের শিক্ষক এই কবির চাকরি-বাকরি নিয়েও টানাটানি শুরু হয়েছে।
আমি তো প্রবাস থেকে গিয়েছিলাম বইমেলা দেখতে। বাংলাদেশ সম্পর্কে নেতিবাচক খবর পত্রিকায় পড়তে পড়তে আমি মাঝে মাঝে খুব হতাশ হতাম। বইমেলায় গিয়ে অনেক নেতিবাচকতা দেখার পরেও বাঙালি মনের অনন্ত আনন্দপ্রবাহ দেখে দারুণ উজ্জীবিত হয়েছি। উদ্দীপনার মধ্যেই কাটিয়ে এসেছি কয়েকটা দিন।
যে কয়দিন ঢাকায় ছিলাম, প্রায় প্রতিদিনই মেলায় যাওয়ার চেষ্টা করেছি।বইমেলায় সবচেয়ে বেশি ভিড় থাকে ছুটির দিনগুলোতে। মূল মেলা হচ্ছে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে। বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণেও বেশ কিছু স্টল আছে।
যারা বলছেন আমাদের ছেলে-মেয়েরা বই-পুস্তক, লেখা-পড়া ছেড়ে দিয়েছে তাদেরকে ভুল প্রমাণ করে তরুণ-তরুণীরা বই কিনছেন, জ্ঞান-বিজ্ঞান, গল্প-উপন্যাসসহ সব ধরনের বই। বই কিনছেন চাকরিজীবী এবং গৃহবধূরাও। শিশুচত্বরেও ছোটরা মা-বাবাকে নিয়ে দেখছে তাদের পছেন্দের বই।
যারা বলছেন বাংলাদেশিরা হাসতে ভুলে গিয়েছে, আনন্দ করা ছেড়ে দিয়েছে তারাও সম্ভবত ভুল বলছেন। মাথায় ফুলের ব্যান্ড লাগিয়ে গলায় ফুলের মালা দুলিয়ে তরুণীরা খিল খিল করে হাসছে সর্বত্রই। তরুণরা ব্যস্ত সঙ্গিনীর ছবি তুলতে। যারা একা, তারা তুলছেন সেলফি, হয়তো মনে মনে ভাবছেন– বই খুঁজতে খুঁজতে পেয়েও যেতে পারেন একজন ভালো বন্ধু।
- ট্যাগ:
- মতামত
- স্টল
- অমর একুশে বইমেলা
- প্যাভিলিয়ন