বিতর্কের উত্তেজনায় যাতে গণতন্ত্র হারিয়ে না যায়
দেশে এ মুহূর্তে জাতীয় সংগীতকে কেন্দ্র করে একটি বিতর্কের সূচনা হয়েছে। এ বিতর্ক প্রধানত সামাজিক মাধ্যমে জারি আছে। জাতীয় সংগীত নিয়ে বিতর্ক নতুন কিছু নয়। শহিদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় আসার পর একটি মহল প্রিন্ট মিডিয়াতে জাতীয় সংগীত নিয়ে বিতর্কের ঝড় তুলেছিল। কিন্তু রাষ্ট্রীয় পর্যায় থেকে এ নিয়ে কোনো রকমের সাড়া না থাকায় বিতর্কটি ধীরে ধীরে স্তিমিত হয়ে পড়ে। তখন সোশ্যাল মিডিয়া ছিল না বলে জাতীয় সংগীত পরিবর্তনের দাবি বহুলভাবে প্রচারিত হতে পারেনি। আমি বলতে চাই না, যারা জাতীয় সংগীত পরিবর্তনের দাবি তুলেছিলেন, সেই সময়ে তাদের যুক্তিতে একেবারেই সারবত্তা ছিল না।
আমাদের জানা দরকার, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত ‘আমার সোনার বাংলা’ কী করে পূর্ব বাংলার বোদ্ধামণ্ডলীর অন্তরে ঠাঁই করে নিল। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর পাকিস্তানের কোনো সুনির্দিষ্ট জাতীয় সংগীত ছিল না। তখন স্কুলের অ্যাসেম্বলিতে পাকিস্তান জিন্দাবাদ, পাকিস্তান জিন্দাবাদ গীত হতো। সম্ভবত এ গানের রচয়িতা ছিলেন নাজির আহমদ। এ গানে পূর্ব বাংলার শ্যামলীমার কথা ছিল, ছিল পশ্চিম পাকিস্তানের দৃশ্যকল্প। ১৯৫৬ সালে পাকিস্তানের জন্মের ৮ বছর পর পাকিস্তানের সংবিধান গৃহীত হয়। এ সংবিধানের প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে সংখ্যা সাম্য এবং পশ্চিম পাকিস্তানের ৪টি প্রদেশকে একটি প্রদেশে পরিণত করে এক ইউনিট ব্যবস্থা চালু করা। এক ইউনিট ব্যবস্থা চালু হওয়ার ফলে পশ্চিম পাকিস্তানের ৪টি প্রদেশ সিন্ধু, বেলুচিস্তান, পাঞ্জাব ও উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ (বর্তমানে খাইবার পাখতুনখোয়া) তাদের সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্য হারিয়ে ফেলেছিল। ১৯৫৬ সালে পাকিস্তানের প্রথম সংবিধান গৃহীত হওয়ার সময় কবি হাফিজ জলন্ধরি রচিত ‘পাক সারজামিন সাদ বাদ’ গানটি পাকিস্তানের জাতীয় সংগীত হিসাবে গৃহীত হয়। আশ্চর্যের বিষয় হলো, গানটি রচিত হয়েছিল ফার্সি ভাষায়, যার ফলে গানটি সাধারণ মানুষকে উদ্বুদ্ধ করতে পারেনি। পূর্ব বাংলা বা তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের মনে গানটি মোটেও ছাপ ফেলতে পারেনি। তবে ১৯৫৮ সালে পাকিস্তানের সংবিধান বাতিল হয়ে গেলেও হাফিজ জলন্ধরির গানটি আজ পর্যন্ত পাকিস্তানের জাতীয় সংগীত হিসাবে থেকে গেছে। দীর্ঘদিন ধরে গীত হওয়ার ফলে গানটি হয়তো সাধারণের বোধগম্য হয়ে উঠেছে।
১৯৫২-এর ভাষা আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন নামে একটি নতুন ছাত্র সংগঠনের জন্ম হয়। জন্মের সময় এ সংগঠনের নেতা ছিলেন মোহাম্মদ সুলতান ও ভাষা মতীন। এই ছাত্র সংগঠনের সহযোগী সাংস্কৃতিক সংগঠন ছিল সংস্কৃতি সংসদ। বাংলাদেশের বেশ ক’জন বিখ্যাত লেখক, কবি, সাহিত্যিক, গায়ক ও নাট্যশিল্পী এ সংগঠনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিলেন। সংস্কৃতি সংসদের উদ্যোগে রবীন্দ্রনাথ রচিত ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’ গানটি জনপ্রিয় করে তোলার বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। ওই সময় পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন ও সংস্কৃতি সংসদের মাতৃ সংগঠন ছিল পূর্ব পাকিস্তানের কমিউনিস্ট পার্টি। এ পার্টিটি নিষিদ্ধ থাকায় এটি আন্ডারগ্রাউন্ড পন্থায় কাজ করত। এই পার্টির ফ্রন্ট অর্গানাইজেশন ছিল পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন, শ্রমিক ফেডারেশন, কৃষক সমিতি এবং পর্যায়ক্রমে আওয়ামী লীগ ও ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির ভেতরে কাজ করত দলটি। মণি সিংয়ের নেতৃত্বাধীন এ কমিউনিস্ট পার্টি বিশ্বাস করত ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের চক্রান্তের ফলে সাম্প্রদায়িকতার ভিত্তিতে ভারত ভাগ হয়ে পাকিস্তানের সৃষ্টি হয়েছে। এই তত্ত্ব মেনে নিলে অবিভক্ত ভারত প্রতিষ্ঠা করতে হয়।
পাকিস্তানের বিখ্যাত উর্দু কবি ফয়েজ আহমদ ফয়েজ ১৯৬৬ সালে ঢাকায় এসেছিলেন। ফয়েজ আহমদ ফয়েজ একজন বড় মাপের কবি ছিলেন। কবিতার ক্ষেত্রে তার অনন্য অবদানের জন্য তিনি সোভিয়েত ইউনিয়নের কাছ থেকে লেনিন পুরস্কারে ভূষিত হয়েছিলেন। কবি ফয়েজ আহমদ ফয়েজের ঢাকা আগমন উপলক্ষ্যে সংস্কৃতি সংসদ বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে এক সংবর্ধনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিল। ওই সময় পূর্ব পাকিস্তানের কমিউনিস্ট পার্টিতে মস্কোপন্থি ও পিকিংপন্থিদের মধ্যে তীব্র দ্বন্দ্ব চলছিল। এ সম্পর্কে ফয়েজ আহমদ ফয়েজকে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বলেছিলেন, Is there any pro-Moscow people here? So far I know, they are all pro-Delhi. এ থেকেই বোঝা যাচ্ছে, পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট আন্দোলনে কী ধরনের রোগ বাসা বেঁধেছিল। ‘আমার সোনার বাংলা’ গানটি বিশেষভাবে সংস্কৃতি সংসদের মাধ্যমে গীত হওয়ার পেছনে ক্রিয়াশীল ছিল, তরুণ সমাজকে পাকিস্তান জাতীয়তাবাদ থেকে মুক্ত করে বাঙালি জাতীয়তাবাদে উদ্বুদ্ধ করা। সেই সময়ের রাজনৈতিক বাস্তবতায় এ উদ্যোগকে আড় চোখে দেখার সুযোগ ছিল না। মজার ব্যাপার হলো, সেই সময় পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ এ গানটি গাওয়া মোটেও সহ্য করতে পারত না। ১৯৫৬ সালে সংস্কৃতি সংসদের অনুষ্ঠানে এ গানটি গীত হওয়ার অপরাধে ছাত্রলীগের মাস্তানরা পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের তৎকালীন সভাপতি আবদুস সাত্তারকে প্রচণ্ড মারধর করে। ছাত্রলীগের এই মেজাজ পরবর্তী বেশ ক’বছর পর্যন্ত অব্যাহত ছিল। তখন ছাত্রলীগ পূর্ণ আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন দাবির স্লোগানেও ক্ষিপ্ত হয়ে উঠত এবং বাধা দেওয়ার চেষ্টা করত। এমন অভিজ্ঞতা আমার আছে। সেই সময় হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ছিলেন আওয়ামী লীগের একচ্ছত্র নেতা। তিনি পাকিস্তানের ঐক্য ও সংহতিতে দৃঢ়ভাবে বিশ্বাসী ছিলেন। ছাত্রলীগও তার চিন্তা-চেতনায় উদ্বুদ্ধ ছিল। সেই সময় ছাত্রলীগ কমিউনিজমের বিরুদ্ধে আদর্শগত প্রচারণা চালাত।
১৯৬৩ সালে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যুর পর শেখ মুজিবুর রহমান ক্রমান্বয়ে আওয়ামী লীগের একচ্ছত্র নেতায় পরিণত হন। তিনি ১৯৬৬ সালে পূর্ব পাকিস্তানের বাঁচার দাবি ৬ দফা পেশ করলে রাজনৈতিক দৃশ্যপট পালটে যায়। ছাত্রলীগের রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিতেও পরিবর্তন আসে। ষাটের দশকের প্রথম দিকে ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক সিরাজুল আলম খান তার নিউক্লিয়াস নামক একটি রাজনৈতিক ইউনিটের মাধ্যমে গোপনে স্বাধীন পূর্ব বাংলার পক্ষে রাজনৈতিক প্রচারণা চালিয়ে যান। বলা হয়ে থাকে, এই প্রচারণার পেছনে শেখ মুজিবুর রহমানের পরিপূর্ণ সায় ছিল। শেখ মুজিবুর রহমানকে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় জড়ানো হয়। রাজনৈতিক প্রচারণার স্বার্থে এ মামলাকে মিথ্যা মামলা বা পিন্ডি ষড়যন্ত্র মামলা বলা হলেও আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার অন্যতম আসামি কর্নেল শওকত আলী ‘সত্য মামলা আগরতলা’ নামে একটি বই রচনা করেছেন। শেখ মুজিবুর রহমানের আগরতলা যাওয়ার বিষয় নিয়ে তার ফুপাতো ভাই মমিনুল হক খোকা ‘অস্তরাগে সূর্য সমুজ্জ্বল’ নামে একটি বই লিখেছেন। কাজেই আগরতলা মামলা সম্পর্কে এখন নতুন নতুন তথ্য প্রকাশ পাচ্ছে, যা পুরোনো বয়ানকে নাকচ করে দেয়।
১৯৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানের ফলে শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৬৯-এর ২২ ফেব্রুয়ারি তার সহ-অভিযুক্তদের নিয়ে কারাগার থেকে মুক্তি লাভ করেন। ১৯৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে পূর্ব বাংলার স্বাধীনতার দাবি স্লোগান আকারে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। ১৯৭০-এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগ পাকিস্তানের জাতীয় সংসদে একক সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হিসাবে আত্মপ্রকাশ করলেও গণতন্ত্রের নীতি অস্বীকার করে পাকিস্তানের সামরিক শাসকরা শেখ মুজিবুর রহমানের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরে ছলচাতুরীর আশ্রয় গ্রহণ করে। শুরু হয় পূর্ব পাকিস্তানব্যাপী অসহযোগ আন্দোলন। কার্যত পাকিস্তানের এ প্রদেশের শাসন পরিচালিত হতো শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশে। বাঙালি জাতীয়তাবাদের এ বিশাল জোয়ারে ছাত্রলীগের কাছে রবীন্দ্রনাথের ‘আমার সোনার বাংলা’ গানটি খুব প্রিয় হয়ে ওঠে। তারা এ গানটিকে স্বাধীন বাংলাদেশের Provisional National Anthem হিসাবে গ্রহণ করার কথা ভাবে। এটি যে একটি সাময়িক জাতীয় সংগীত, তা আমাদের জানিয়ে দিলেন প্রয়াত অধ্যাপক আফতাব উদ্দিন আহমদ। তিনি ‘জয়বাংলা’ স্লোগানেরও উদগাতা ছিলেন।