মাত্রাজ্ঞান
আমরা যখন ছোটবেলায় স্বরবর্ণ-ব্যঞ্জনবর্ণ শিখেছি, তখন পণ্ডিতমশাই মাত্রাজ্ঞান শিখিয়েছিলেন। কোন অক্ষরের ওপরে মাত্রা দিতে হবে, কোন জায়গায় দিতে হবে বা দিতে হবে না, এই জ্ঞান জরুরি ছিল। শব্দ গঠন করার জন্য মাত্রাজ্ঞান বিশেষ প্রয়োজন।
এই প্রসঙ্গে ছোট্ট একটা গল্প বলি। সেই ব্রিটিশ আমলের কথা। তখন গ্রামাঞ্চলে অক্ষরজ্ঞানসম্পন্ন মানুষ ছিল, তবে তাদের সংখ্যা ছিল হাতে গোনা। গ্রামের এক লোক ঢাকায় এসে নির্দিষ্ট ঠিকানায় একটি কাজ নিয়েছিলেন। ঠিকানা ছিল-৬৬ নং, একটি লেনের নাম।
লোকটি পরবর্তী সময়ে গ্রামে বিয়েশাদি করলেন, ভালো ঘরের মেয়ে আনলেন। মেয়েটি অক্ষরজ্ঞানসম্পন্ন, লেখাপড়া কিছুটা জানেন।মোটামুটি বানান করে হলেও চিঠি পড়তে পারেন। ভদ্রলোক স্ত্রীর কাছে ঢাকার ৬৬ নং লেনের ঠিকানা দিয়ে আসলেন। সুন্দর করে তা আগলে রাখলেন তাঁর স্ত্রী। একবার ভদ্রলোকের বড় ভাই ঢাকায় যাবেন বেড়াতে, ছোট ভাইয়ের কাছে যাবেন, বৌমার কাছ থেকে ঠিকানা নিলেন। আগেই বলেছি, বৌমা অক্ষরজ্ঞানসম্পন্ন। তিনি সুন্দর করে নিজের হাতে একটু কষ্ট করে লিখে দিলেন, ‘ড ড নং, লেনের নাম’।
বড় ভাই ঢাকায় এসে তন্ন তন্ন করে খুঁজে দেখলেও ‘ড ড নং’ কোনো অফিসের ঠিকানা পেলেন না। ভগ্ন মনে বাড়িতে গিয়ে বৌমার কাছে জিজ্ঞেস করলেন, ‘তুমি যে ঠিকানা দিয়েছিলে, ঢাকা শহরে এই রকম কোনো ঠিকানা নাই, ঠিকানাটা একটু দেখাও তো।’ তখন সবাই মিলে দেখল ঠিকানা ছিল ‘৬৬ নং, লেনের নাম’। বৌমাকে জিজ্ঞেস করতে তিনি উত্তর দিলেন, ‘আমি তো সুন্দর করে মাত্রা দিয়ে লিখে দিয়েছি।’ অর্থাৎ বৌমার অক্ষরজ্ঞান থাকলেও মাত্রাজ্ঞান ছিল না, তাই ‘৬৬’ হয়ে গেল ‘ড ড’।
গত আগস্টের ৫ তারিখে আমাদের রাষ্ট্র-সমাজে একটা মহাপরিবর্তন ঘটে গেল। এই পরিবর্তন ঘটার অনেক কারণ থাকতে পারে। যে যেভাবেই বিশ্লেষণ করেন না কেন, সাদা চোখে দেখলে সাধারণ মানুষ দেখবে কোটা আন্দোলন। এই কোটা আন্দোলন শুরু হয়েছিল ২০১৭ সালে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ সারা দেশের ছাত্রদের দাবির মুখে তদনীন্তন রাষ্ট্রপ্রধান ২০১৮ সালে সংসদে ঘোষণা করেছিলেন, কোনো কোটাপদ্ধতি থাকবে না।
এই সময় যদি সংবিধান মোতাবেক অনগ্রসর মানুষের জন্য, যেটা সংবিধানে আছে, সেই রকম কোটা রেখে সংশোধন করা হতো, তাহলে বর্তমানে এই কোটা সম্পর্কে কোনো কথা আসত না। এই কোটা বাতিল প্রশ্নটা এসেছে বিরাগের বশবর্তী হয়ে, তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী কোটা বাতিল করেছিলেন বলে। আবার যখন দেখা গেল, মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের দিয়ে কোটা পূরণ হচ্ছে না, কোনো গবেষণা বা দাবি ছাড়াই তখন ঘোষণা করা হলো, মুক্তিযোদ্ধাদের নাতিপুতিরা কোটায় চাকরি পাবে। এই ঘোষণাও ছিল অনুরাগের বশবর্তী হয়ে।
উল্লিখিত দুই ক্ষেত্রেই মাত্রাজ্ঞান প্রয়োগ করা হয়নি। সঠিক সময়ে সঠিক জায়গায় মাত্রা যদি না দেওয়া হয়, অথবা যে জায়গায় মাত্রা দরকার নেই, সেখানেও যদি মাত্রা দেওয়া হয়, তাহলে পরিস্থিতি সম্পূর্ণ পাল্টে যায়। যার প্রমাণ আমরা ৫ আগস্ট দেখলাম।
এখানে একটা কথা প্রসঙ্গিক। আপনি দলের নেতা, রাষ্ট্র পরিচালনা করেন। আপনার ভাবতে হবে, দলীয় নেতা-কর্মীদের আপনি কতটুকু প্রশ্রয় দেবেন। আপনি কি রাষ্ট্রীয় আইনকানুন, সংবিধান মেনে নেতা-কর্মীদের পরিচালনা করবেন, না তাঁদের উচ্ছৃঙ্খলতা, খামখেয়ালিপনা, স্বার্থপরতা, দখলবাজি, চাঁদাবাজিকে উৎসাহিত করবেন? এটা আপনাকেই ঠিক করতে হবে। এখানেও মাত্রাজ্ঞান প্রয়োজন, কতটুকু আইন, কানুন, বিধিবিধানের মধ্য থেকে করা যায়, যেটা সমাজের চোখে কোনো দোষের নয়। আবার যদি মাত্রাতিরিক্ত প্রশ্রয় দেন তাহলে বিপর্যয় ঘটবে, যা প্রমাণিত।
উন্নয়নের কথা বলা হয়। শুধু উন্নয়ন দিয়ে জনগণের মন রক্ষা করা যায় না, সেখানে যদি সুশাসন না থাকে। উন্নয়ন যদি এমন হয় যে রাজধানী থেকে বিভাগ, বিভাগ থেকে জেলা, জেলা থেকে উপজেলা, উপজেলা থেকে ইউনিয়ন, ইউনিয়ন থেকে গ্রাম, গ্রাম থেকে প্রতিটি বাড়িতে, পাড়ায়-মহল্লায় একেবারে কার্পেট বিছানো রাস্তা থাকবে, মানুষের আয়ের পথ থাকবে, তিন বেলা খেয়েও যদি সবার বাড়িঘর থাকে! তারপরেও যদি সাধারণ মানুষকে সরকারি কোনো অফিসে সাধারণ সেবা পেতে গেলে হয়রানির শিকার হতে হয়, এই মানুষ বিক্ষিপ্ত হবেই। সেই রকম ইউনিয়ন পরিষদ, পৌরসভা বা সিটি করপোরেশনের কোনো সেবা পেতে হলে যদি ঘুষ দিতে হয়, তাহলে এই মানুষের কাছে উন্নয়নের কোনো মূল্যায়ন হবে না।
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে মোটের ওপর বলতে গেলে সাধারণ মানুষ সরকারি কোনো অফিস বা সংস্থা থেকে বিনা হয়রানিতে কোনো রকম কোনো সেবা পেয়েছে, সে রকম নজির নেই। বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের ১৫ বছরে এর মাত্রা আরও বেড়ে গিয়েছিল, এ কথা স্বীকার করতেই হবে। যেখানেই তাকান, যেখানেই যান, যার কাছ থেকে সেবা পেতে চান, কোনো সাহায্য চান, নিজের প্রাপ্যতাই চান, সবখানেই ছিল সীমাহীন ভোগান্তি। মানুষ ক্ষুব্ধ হয়েছে, অন্তর জ্বালায় প্রতিনিয়ত জ্বলেছে।