ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বিনয় মোহন কোয়াত্রা দুই দিনের সফরে বুধবার ঢাকায় এসেছিলেন। বৃহস্পতিবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ এবং পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেনের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠক করে ওই দিনই ফিরে গেছেন তিনি।
সৌজন্য সাক্ষাৎ শেষে আলোচ্য বিষয় প্রসঙ্গে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ বলেছেন, ‘তিস্তায় আমরা একটি বৃহৎ প্রকল্প নিয়েছি। ভারত সেখানে অর্থায়ন করতে চায়। সহায়তা প্রস্তাব নিয়ে আজ আলোচনা হয়েছে। তিস্তায় যে প্রকল্পটি হবে, সেটি আমাদের প্রয়োজন অনুযায়ী হবে। তাই আমাদের প্রয়োজন যেন পূরণ হয়, এটি ভারতকে বলা হয়েছে।’ (সমকাল, ৯ মে ২০২৪)
আসলে, প্রতিবেশী দেশের পররাষ্ট্র সচিবের সফরটি ২০ এপ্রিল অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু ‘অনিবার্য কারণবশত’ এক দিন আগে সফরটি ‘স্থগিত’ হয়ে যায়। কথা ছিল, তিনি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির পক্ষ থেকে দিল্লি সফরের আমন্ত্রণ পৌঁছে দেবেন।
তারও আগে, ঢাকায় নিযুক্ত চীনের রাষ্ট্রদূত ইয়াও ওয়েন ৩ এপ্রিল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা করে তাঁর দেশের পক্ষ থেকে জুলাই মাসের প্রথম সপ্তাহে রাষ্ট্রীয় সফরের আমন্ত্রণ পৌঁছে দেন। দৃশ্যত এর পরই নয়াদিল্লি নড়েচড়ে বসে। তারা চায়, চীন সফরের আগেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারত সফর করুন। যদিও নির্দিষ্ট দিনক্ষণ জানা যায়নি, ধরে নেওয়া যায়, জুনের মধ্যেই সেটা সম্পন্ন হবে। জুলাইয়ের প্রথম সপ্তাহে চীন সফরের কর্মসূচি স্থির রেখে তার আগেই ভারত সফর নিশ্চিত করতে হলে এর বিকল্পও নেই।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে নিজ নিজ দেশে আমন্ত্রণ জানাতে চীন ও ভারতের এই প্রতিযোগিতার তাৎপর্য বহুমুখী। আমার সামান্য পর্যবেক্ষণমতে, এ ক্ষেত্রে তিস্তায় প্রস্তাবিত ও বহুল আলোচিত ‘মহাপরিকল্পনা’ একটি ভূমিকা রাখছে। গত বছর থেকেই প্রকল্পটি বাস্তবায়নে একই সঙ্গে বেইজিংয়ের তাড়া, দিল্লির আপত্তি এবং ঢাকার দ্বিধা বকলমে স্পষ্ট হয়ে উঠছিল।
দুই.
অনেকের মনে থাকার কথা, ২০১৯ সালের শেষ দিকে ‘তিস্তা মহাপরিকল্পনা’ নিয়ে সংবাদমাধ্যম, সামাজিক মাধ্যম ও রংপুর অঞ্চলে রাজনীতির মাঠ সরগরম হতে থাকে। ২০২০ সালের জুলাই মাসে ‘তিস্তা নদী সমন্বিত ব্যবস্থাপনা ও পুনরুদ্ধার প্রকল্প’ বিষয়ক একটি প্রাথমিক প্রস্তাবও পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় থেকে পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানো হয়। তারপর থেকেই সম্ভবত পর্দার অন্তরালে নানা আলোচনা চলতে থাকে। এর আভাস পাওয়া যায় মঞ্চের কুশীলবদের নানা কথায়।
যেমন ২০২২ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি সংসদ সদস্য ও তৎকালীন বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি রংপুরে এক অনুষ্ঠানে বলেন, তিস্তা মহাপরিকল্পনা নিয়ে ‘আন্তর্জাতিক একটা ছোট ঝামেলা আছে, এ কারণে বিলম্ব হচ্ছে।’ কী সেই ঝামেলা? ২০২২ সালের ২৮ ডিসেম্বর তৎকালীন পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান বলেন, তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে ‘অবশ্যই ভারতের সঙ্গে সমঝোতা করা হবে’ (ডেইলি স্টার অনলাইন)। ২০২৩ সালের ২ আগস্ট রংপুর সফরে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমাদের তিস্তা মহাপরিকল্পনা– সেটাও আমরা বাস্তবায়ন করব।’
বাংলাদেশে নিযুক্ত তৎকালীন চীনা রাষ্ট্রদূত লি জিমিংও ঢাকায় আয়োজিত এক সেমিনারে বলেন, তিনি ব্যক্তিগতভাবে ‘কনসার্নড’ যে, তিস্তা প্রকল্প নিয়ে বাংলাদেশ সরকার ‘বাইরের চাপে’ অবস্থান পরিবর্তন করে কিনা (ইউএনবি, ১৪ অক্টোবর ২০২২)।
যদিও গত বছরের ২১ ডিসেম্বর ঢাকায় নিযুক্ত চীনের বর্তমান রাষ্ট্রদূত ইয়াও ওয়েন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর তিস্তা প্রকল্পের কাজ শুরুর বিষয়ে আশাবাদ ব্যক্ত করেন; এক সপ্তাহ পর ২৮ ডিসেম্বর পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র সেহেলী সাবরীন বলেন, তিস্তা প্রকল্পে চীনের প্রস্তাবে ভারতের আপত্তি থাকলে ‘ভূরাজনৈতিক বিবেচনায়’ এগোতে হবে।
- ট্যাগ:
- মতামত
- তিস্তার পানি চুক্তি