নারী মানেই আনাড়ি নয়
যখন আমরা নারীকে জায়া-জননী-আত্মজা হিসেবে চিহ্নিত করি, তখন আমরা তাদের মহিমান্বিত করি। কিন্তু এর কোনোটাই নারীর সবচেয়ে বড় পরিচয় নয়। নারীর সবচেয়ে বড় পরিচয় সে মানুষ।
তিনটি কথা প্রথমেই বলে নেই। প্রথমত আমি শিবরাম চক্রবর্তীর পরম ভক্ত। তাঁর শব্দের খেলা আমার ভারি ভালো লাগে। ওই যে, ‘ধার করি আমরা উদ্ধার পাওয়ার জন্য’ কিংবা ‘স্বামী মানেই আসামি’। এবার ভাবলাম আমিও সে রকম একটু চেষ্টা করে দেখি না! বেশ ধস্তাধস্তির পরে বোঝা গেল, ও আমার কম্ম নয়। এখন যেমন ‘লেজেগোবরে’ অবস্থা আমার, তখন আমাকে বাঁচিয়ে দিল আমাদের শামীম—সতীর্থ বন্ধু শামীম আজাদ।
সেটাই আমার দ্বিতীয় কথা, তাঁর একটা লেখার শিরোনাম দেখেছিলাম, ‘নারী মানেই আনাড়ি নয়’। সেটাই চেয়েচিন্তে নিলাম তাঁর কাছ থেকে। অনেকটা ধার করলাম উদ্ধার পাওয়ার জন্য। ‘বাহ্, দোষের কী হলো?’ ‘বন্ধুকে বন্ধু না দেখিলে আর কে দেখিত?’ ওই আবারও শিবরাম, ‘চক্কোত্তিকে চক্কোন্তি না দেখিলে আর কে দেখিবে?’
আর তৃতীয়ত, হাসি-ঠাট্টা ছেড়ে দিয়ে গুরুগম্ভীরতার সঙ্গে বিষয়টির গুরুত্ব বোঝা প্রয়োজন। পুত্রবধূ নির্বাচনী পরীক্ষা নিচ্ছেন এক ভদ্রলোক। ‘রান্না জানো?’ ‘সামান্য’, মেয়েটির শান্ত উত্তর। ‘বড়ি দিয়ে কুমড়োশাক কী করে রাঁধতে হয়?’ কিছু একটা বলল মেয়েটি। কিন্তু নিঃসন্দেহে সেটি সঠিক উত্তর নয়। ‘সেলাই করতে পারো?’ প্রশ্নের রেলগাড়ি চলতেই থাকে। ‘না’—চোখভরা জল মেয়েটির। ‘তুমি তো দেখছি একেবারেই আনাড়ি’—রায় ঘোষিত হয়ে গেল।
বড় মায়া হয় মেয়েটির জন্য আমার—আমারই তো এক ভ্রাতুষ্পুত্রী সে। ‘আপনি আবৃত্তি করতে পাবেন?’ জানতে চাই আমি ভদ্রলোকটির কাছে। সারা ঘরের সব কথা থেমে যায়। ভদ্রলোক হতবাক! ‘না’, অবাক গলায় বলেন তিনি। ‘পিরিচে একটুকুও চা না ফেলে ভরা কাপ চা নিয়ে আসতে পারেন?’ আমার ভাবির রক্তচক্ষু সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে প্রশ্নবান ছুড়ে দিই আমি ওই ভদ্রজনের প্রতি। ‘চেষ্টা করিনি কখনো!’ তাঁর কণ্ঠের কাঠিন্য টের পাই আমি। ‘ছোট্ট একটা হাতুড়ি দিয়ে দেয়ালে একটুও ক্ষত না করে এক বাড়িতে পেরেক লাগাতে পারেন?’ ভদ্রলোকের চোখে চোখ রেখে বলি আমি। রাগে ভদ্রলোক কথা পর্যন্ত কন না। এবার শক্ত গলায় বলি আমি, ‘আপনি তো ওর চাইতেও আনাড়ি। ও তো এই সবকিছু পারে অনায়াসে।’
ওই পক্ষ চলে গেলে তিরস্কারের বন্যা বয়ে যায় আমার ওপর দিয়ে। ভাই-ভাবি আমার সঙ্গে এক মাস কথা কননি। আমার বাচালতায় বিরক্ত হয়েছিলেন আমার খালা। শুধু যখন চলে আসি, তখন মেয়েটি আমার কাছে এসে ফিসফিসিয়ে বলেছিল, ‘চাচা, আজ একমাত্র তুমিই আমার সম্মান রক্ষা করলে।’ ওর চিবুকে আলতো করে আদর করে বেরিয়ে আসি।
এই আখ্যানের একটি পাদটীকা আছে। সেদিনের সেই তরুণী পশ্চিমের এক নামী বিশ্ববিদ্যালয়ের পূর্ণ অধ্যাপক, স্থাপত্য বিভাগে। সেখানে বিভাগীয় প্রধানও সে। যে দক্ষতায় সে বিভাগীয় প্রশাসন চালায়, সেই একই দক্ষতায় সে অনেক সুরম্য ভবনের নকশা করেছে! দুর্দান্ত রাঁধুনি সে, সূচিকর্মেও তার জুড়ি নেই, বড়ির পাঁচ রকমের রান্না সে আমাকে খাইয়েছে। সে নারী নিঃসন্দেহে, কিন্তু আনাড়ি নয় কোনোমতেই।
- ট্যাগ:
- মতামত
- আন্তর্জাতিক নারী দিবস