প্রথম আলো ও ডেইলি স্টারে হামলা এবং পুরোনো রাজনীতির নতুন পোশাক
গত বৃহস্পতিবার (১৮ ডিসেম্বর, ২০২৫) রাতে একের পর এক অনেক ঘটনা ঘটেছে। একদল উগ্রপন্থী দেশের দুটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পত্রিকা অফিস, প্রথম আলো আর দ্য ডেইলি স্টার ভবনে হামলা করছে, আগুন ধরিয়ে দিয়েছে। এরপর তারা চলে গেছে দেশের স্বনামধন্য সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান ছায়ানটের দিকে। এরপর উদীচী। ধর্ম অবমাননার অভিযোগে ময়মনসিংহের ভালুকায় হিন্দু ধর্মের এক যুবককে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে। হত্যার পর ওই যুবকের মরদেহ গাছের সঙ্গে বেঁধে আগুন দেওয়া হয়েছে। একজন সাংবাদিককে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে, যিনি খুলনায় এক প্রেসক্লাবের সভাপতি ছিলেন।
নানা জায়গায় ভাঙচুর ও হামলা হয়েছে। ফেসবুকে একের পর এক ভিডিও ঘুরছে। কোথাও দেখা যাচ্ছে সিনিয়র সাংবাদিক নূরুল কবীরের ওপর হামলা হচ্ছে, কোনো ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে ভাঙচুর আর অগ্নিসংযোগ। ডেইলি স্টার–এর এক তরুণী সাংবাদিক ফেসবুকে লিখলেন, ধোঁয়ায় তিনি শ্বাস নিতে পারছেন না। ৩০ জনের বেশি সাংবাদিক ডেইলি স্টার ভবনের ছাদে আটকে ছিলেন, ঠিক সেই সময় নিচে আগুন লাগানো হয়। কয়েক ঘণ্টা পর তাঁদের উদ্ধার করা হয়। এখানে যে প্রশ্নটা তোলা যায়: টার্গেট কি কেবল ভবনটা, নাকি ভবনের ভেতরে থাকা মানুষগুলোও?
প্রথম আলো, ডেইলি স্টার, উদীচী বা ছায়ানট—এগুলোর কেউই হাদির ওপর হামলার সঙ্গে কোনোভাবে জড়িত না। তারা হামলা পরিকল্পনা করেনি, সমর্থনও করেনি; বরং তাদের অনেক সাংবাদিকই প্রথম দিকে এ হামলার খবর করেছে এবং নিন্দা জানিয়েছে। আক্রান্ত পত্রিকা দুটি হাদির ওপর হামলার নিন্দা জানিয়ে ও উদ্বেগ প্রকাশ করে সম্পাদকীয় ও কলাম প্রকাশ করেছে। তবু দেখা গেল, একই চেনা মুখেরা টেলিভিশনের টক শো, রাস্তার সমাবেশ আর ফেসবুক-ইউটিউব মিলিয়ে এই সব প্রতিষ্ঠানকে ‘সহযোগী’ বানিয়ে ফেলছে।
আমরা তাদের চেহারা চিনি: রাতের টক শোতে চিৎকার করে কথা বলে, দিনে মাইক হাতে উসকানি দেয়, আর সোশ্যাল মিডিয়ায় কনটেন্ট-ক্যাম্পেইন চালায়। প্রকৃত হামলাকারী কারা, কার নির্দেশে, কার সংগঠনে হামলা হয়েছে, সেই প্রশ্ন করার বদলে তারা আবারও আগের ‘শত্রুর’ দিকেই আঙুল তুলছে, যেন সমালোচনামূলক পত্রিকা বা সাংস্কৃতিক সংগঠন হিসেবে টিকে থাকাটাই আসল অপরাধ।
এটা একধরনের কৌশল। গণমাধ্যম ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানের ওপর দোষ চাপিয়ে তারা আসলে লড়াইয়ের ময়দানটাই বদলে দিতে চাইছে। বার্তাটা পরিষ্কার: যারা তাদের স্লোগান, তাদের রাজনৈতিক বয়ান, তাদের ইতিহাসের বয়ান পুরোপুরি মেনে নেবে না—এরা সবাই শত্রু।
এই যুক্তিতে একজন সাংবাদিক, কোনো সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানের শিল্পী বা দলমত-নির্বিশেষে সবার পক্ষে কথা বলা কোনো শিক্ষককে হত্যাকারীর সমান জায়গায় দাঁড় করিয়ে দেওয়া হয়। একবার যখন এই সীমা পেরোনো হয়, তখন তাদের বিরুদ্ধে সবই ন্যায্য হয়ে যায়: হয়রানি, সামাজিক বয়কট, এমনকি শারীরিক আক্রমণও। সবকিছুর গায়ে আবার সুন্দর শব্দ বসানো হয়: ‘অসমাপ্ত বিপ্লব’, ‘ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা’, ‘দেশ পরিশুদ্ধ করা’। প্রতিশোধকে নৈতিকতার মোড়কে বেচা হয়।
আমরা যা দেখছি, তা শোককে পুরোনো হিসাব মিটিয়ে ফেলার ফাঁকা চেকে পরিণত করার চেষ্টা। প্রকৃত হামলাকারীদের দিকে, আর একজন নাগরিককে রক্ষা করতে ব্যর্থ রাষ্ট্রের দিকে ক্ষোভ ঘুরিয়ে দেওয়ার বদলে, এরা হাদির কষ্টকে ব্যবহার করছে তাদের অপছন্দের সব কণ্ঠকে চুপ করিয়ে দিতে। তারা নিরাপদ বা ন্যায়ভিত্তিক বাংলাদেশ গড়তে চায় না, তারা চায় এমন একটা বাংলাদেশ, যেখানে জনপরিসরে কেবল একধরনের কণ্ঠ থাকবে। এটা কোনো বিপ্লব না; এটা পুরোনো বাদ দেওয়া রাজনীতিরই নতুন পোশাক।
বাংলাদেশে রাজনৈতিক সহিংসতা নতুন কিছু না। জুলাই-আগস্টে আমরা দেখেছি ক্ষমতাচ্যুত হাসিনা সরকার এ দেশের মানুষের ওপর কীভাবে হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছিল। সে সরকারের পতন শেষে মুহাম্মদ ইউনূস সরকারের দায়িত্ব নেওয়ার পর অনেকে ভেবেছিলেন, নতুন সরকার প্রথমে দেশকে স্থিতিশীল করবে, নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে, তারপর নির্বাচন আয়োজন করে নির্বাচিত সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করবে।