কর্মবিরতি ইস্যু: শিক্ষকদের দায়িত্বহীনতা সমাজের নৈতিক ভিত্তি দুর্বল করে

প্রথম আলো ড. মাহরুফ চৌধুরী প্রকাশিত: ১০ ডিসেম্বর ২০২৫, ১৯:৩৪

সম্প্রতি বার্ষিক পরীক্ষার সময় প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষকদের কর্মবিরতি আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় এক গভীর নৈতিক সংকট সামনে এনেছে। সমাজের যে পেশাজীবী শ্রেণি জ্ঞান, আদর্শ ও নৈতিকতার প্রতীক হিসেবে মর্যাদা পায়, তাদের কাছ থেকে দায়িত্বহীন আচরণ কেবল হতাশাজনকই নয়, বিপজ্জনকও বটে। কারণ, শিক্ষকতা আর দশটা চাকরির মতো নয়; এটি একধরনের নৈতিক প্রতিশ্রুতি, এক সামাজিক চুক্তি।


এ পেশায় শিক্ষক নিজের আচরণের মাধ্যমে পরবর্তী প্রজন্মকে দায়িত্ববোধের শিক্ষা দেন। শিক্ষার্থীদের শুধু পাঠ্যবইয়ের পড়া না শিখিয়ে কীভাবে সদাচরণ করতে হয়, কীভাবে কর্তব্যনিষ্ঠ হতে হয়, তা শেখানোই হচ্ছে শিক্ষকতা পেশার প্রকৃত কাজ। অতএব প্রাথমিকের শিক্ষকদের একাংশের পরীক্ষার মতো সংকটময় সময়ে শিক্ষার্থীদের বেকায়দায় ফেলে নিজেদের দাবি আদায়ের কর্মসূচিতে অংশ নেওয়া নিঃসন্দেহে পেশাগত নীতিভ্রষ্টতা।


বর্তমানে বাংলাদেশে বিভিন্ন পেশাজীবীর ক্ষেত্রে যেমন দাবি আদায়ের অজুহাতে হঠাৎ রাস্তায় নামা বিশেষ নিয়মে পরিণত হয়েছে, শিক্ষকদের এ কর্মবিরতিও সেই সামগ্রিক অবক্ষয়েরই আরেকটি দৃষ্টান্ত। ফলে কেবল শিক্ষার্থীর ভবিষ্যৎই অনিশ্চয়তার মুখে পড়ে না, গোটা সমাজেও নৈতিক নেতৃত্বের এক গভীর সংকট তৈরি হয়।


শিক্ষার্থীদের কাছে শিক্ষক যে আদর্শ বা আচরণগত দৃষ্টান্ত তুলে ধরেন, তা কেবল কোনো নৈতিক পরামর্শ নয়, বরং একটি গভীর সামাজিক সত্য, যার ধারাবাহিকতা মানবসভ্যতার ইতিহাসেই দৃশ্যমান। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে শিক্ষককে সমাজে নৈতিক দিশারি, আলোক প্রদর্শক এবং মূল্যবোধের বাহক হিসেবে দেখা হয়েছে। এ কারণেই শিক্ষকতা পেশায় ব্যক্তিগত আচরণের প্রশ্ন কেবল ব্যক্তিগত পরিসরে সীমাবদ্ধ থাকে না; তা শিক্ষার্থীর চিন্তা, চরিত্র ও ভবিষ্যৎ নাগরিক পরিচয়কে নির্ধারণ করে।


এ অবস্থায় কোনো শিক্ষক যদি বছর শেষে কোর্স সমাপনী পরীক্ষার মতো সংবেদনশীল মুহূর্তে নিজ দাবি আদায়ের লক্ষ্যে সচেতনভাবে কর্মবিরতিতে গিয়ে রাষ্ট্রকে চাপ দেওয়ার কৌশল অবলম্বন করেন, তবে তা শিক্ষার্থীদের প্রতিদিন শেখানো দায়িত্ববোধ, সময়ানুবর্তিতা ও নৈতিকতার মৌলনীতিরই সরাসরি পরিপন্থী। কারণ, শিক্ষক নিজেই যদি নৈতিক আচরণের মানদণ্ড অমান্য করেন, তবে শিক্ষার্থীর কাছে নীতি ও দায়িত্বশীলতা কেবল মুখের কথা হয়ে দাঁড়ায়।


দর্শনের ভাষায় বলা যায়, শিক্ষকের ব্যক্তিগত আচরণই শিক্ষার্থীর জন্য প্রথম ও জীবন্ত পাঠশালা। আর এখানেই পেশাজীবী হিসেবে তাঁর সামাজিক দায়িত্ববোধ সর্বাধিক। গ্রিক দার্শনিক অ্যারিস্টটলের মতে, চরিত্র গঠনের প্রধান উপায় হলো ‘অনুশীলন’ ও ‘অনুকরণ’। সুতরাং শিক্ষক যদি অনুকরণের যোগ্য নৈতিক দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে ব্যর্থ হন, তবে তা কেবল ব্যক্তিগত বিচ্যুতিই নয়, সমাজের মানুষগুলোর নৈতিক কাঠামোর ভিতকেও দুর্বল করে দেয়।


পরীক্ষার তারিখ পেছানো বা পরীক্ষার অনিশ্চয়তা শিক্ষার্থী ও তাদের অভিভাবকদের ওপর তীব্র মানসিক চাপ সৃষ্টি করে। এই অপ্রত্যাশিত মানসিক চাপ তাদের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা ও আত্মবিশ্বাসকে সরাসরি বিঘ্নিত করে।


মাসের পর মাস অধ্যবসায়ের পর হঠাৎ পরীক্ষার স্থগিতাদেশ শিক্ষার্থীদের মধ্যে যে হতাশা ও বিভ্রান্তি তৈরি করে, তা শুধু তাৎক্ষণিক সমস্যা নয়; বরং দীর্ঘ মেয়াদে তাদের শিক্ষার ধারাবাহিকতা ও মনোবলকে দুর্বল করে। উচ্চশিক্ষায় ভর্তির সময়সূচি, বৃত্তির আবেদন কিংবা পরবর্তী ক্যারিয়ার-পরিকল্পনার প্রতিটি ধাপই নির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যে সম্পন্ন হওয়ার প্রয়োজন হয়। এই সময়সীমা ভেঙে গেলে একটি সম্পূর্ণ ব্যাচের জীবন-পরিকল্পনা ব্যাহত হয় এবং সেই ক্ষতি অনেক সময় পূরণ করা সম্ভব হয় না।


মনোবিজ্ঞানের ভাষায় ‘শিক্ষাগত অনিশ্চয়তা’ উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা, আত্মবিশ্বাসহীনতা এবং হতাশা বাড়ায়, যা বিভিন্ন গবেষণায় সুপ্রতিষ্ঠিত। যে শিক্ষকেরা এই মানসিক ও ভবিষ্যতের ক্ষতির পরোয়া না করে কেবল নিজেদের আর্থিক স্বার্থ রক্ষায় পরীক্ষার সময় কর্মবিরতিতে যান, তাঁরা প্রকৃত অর্থে জাতিগঠনের দায়িত্ববোধসম্পন্ন শিক্ষকতার নৈতিক মানদণ্ডে উত্তীর্ণ নন। বরং তাঁরা শিক্ষার স্বাভাবিক ধারাবাহিকতা ব্যাহত করে ভবিষ্যৎ নাগরিক গঠনের পথকেই বিপন্ন করে তোলেন, যার ফলে সমাজের মানবসম্পদ উন্নয়ন ও রাষ্ট্রীয় অগ্রগতির ভিত্তি দীর্ঘ মেয়াদে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

সম্পূর্ণ আর্টিকেলটি পড়ুন

প্রতিদিন ৩৫০০+ সংবাদ পড়ুন প্রিয়-তে

আরও