স্পেকট্রামের ‘দ্বৈত চার্জ’–অযৌক্তিক বোঝা কেন বহন করবে টেলিকম খাত?
সময়ের পরিক্রমায় বাংলাদেশের টেলিকম খাত দেশের ডিজিটালাইজেশন অভিযাত্রার অন্যতম প্রধান বাহক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে। সামাজিক রূপান্তর, অর্থনৈতিক অন্তর্ভুক্তি ও প্রযুক্তিগত অগ্রগতির প্রতিটি ধাপে এই খাতের অবদান আজ স্পষ্ট ও অনস্বীকার্য। তবে এই অগ্রযাত্রার আড়ালে জমেছে এক অস্বস্তিকর বাস্তবতা, ক্রমবর্ধমান আর্থিক চাপ, যা এখন খাতটির টেকসই উন্নয়নের পথে বড় বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। অবকাঠামো সম্প্রসারণ থেকে নেটওয়ার্ক আধুনিকায়ন প্রতিটি ক্ষেত্রেই প্রয়োজন বিপুল বিনিয়োগ; কিন্তু বর্তমান ব্যয় কাঠামো অপারেটরদের সেই সক্ষমতাকে সংকুচিত করে ফেলছে।
সবচেয়ে উদ্বেগজনক বিষয় হলো স্পেকট্রাম খাতে ‘দ্বৈত চার্জ’ আরোপ। মোবাইল ফোনে কথা বলা, ইন্টারনেট চালানো বা ভিডিও দেখা—এই সবকিছুর পেছনে কাজ করে এক অদৃশ্য সম্পদ, যার নাম স্পেকট্রাম। সহজভাবে বললে, স্পেকট্রাম হলো রেডিও তরঙ্গের সেই নির্দিষ্ট ‘আকাশপথ’, যার ওপর ভর করে মোবাইল নেটওয়ার্ক চলে। এই স্পেকট্রাম ব্যবহারের জন্য সরকার একদিকে অপারেটরদের কাছ থেকে নিলামের মাধ্যমে বড় অঙ্কের টাকা নেয়, আবার অন্যদিকে প্রতি বছর আলাদা করে ব্যবহারের চার্জও আদায় করে। এই নীতি অপারেটরদের খরচ অস্বাভাবিকভাবে বাড়িয়ে দিচ্ছে, যা ভবিষ্যতে টেলিকম খাতের স্থিতিশীলতা, উদ্ভাবন এবং গ্রাহকসেবার মানকে হুমকির মুখে ফেলতে পারে।
২০০৫ সালে বর্তমানের ফর্মুলা অনুযায়ী বার্ষিক স্পেকট্রাম চার্জ চালু হওয়ার সময় মূল উদ্দেশ্য ছিল স্পেকট্রাম ব্যবস্থাপনা ও মনিটরিং সম্পর্কিত সরকারের খরচ মেটানো। সেই সময় স্পেকট্রাম কেনা বা অধিগ্রহণের জন্য আলাদা কোনো ফি ছিল না। কিন্তু ২০০৮ সালের পর পরিস্থিতি পুরোপুরি বদলে যায়। চালু হয় স্পেকট্রাম কেনার জন্য আলাদা ফি, যা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আকাশছোঁয়া হয়ে ওঠে।
২০০৮ সালে প্রতি মেগাহার্টজ স্পেকট্রাম কেনার মূল্য ছিল ৬৭ কোটি টাকা; ২০২১ সালের নিলামে তা বেড়ে পৌঁছায় ২৬৩ কোটিতে–বৃদ্ধির হার ২৯৩ শতাংশ। এর মধ্যে ২০১৩–২০১৮ সময়টা ছিল সবচেয়ে কঠিন; মাত্র পাঁচ বছরে স্পেকট্রাম কেনার ব্যয় বেড়েছে ৬৭ শতাংশ। একই সময়ে অপারেটরদের গ্রাহকসংখ্যা ও নেটওয়ার্ক বিস্তারের পাশাপাশি আতিরিক্ত স্পেকট্রাম কেনার কারণে বার্ষিক স্পেকট্রাম ব্যবহারের ফিও বৃদ্ধি পেয়েছে। অর্থাৎ উভয় দিক থেকেই স্পেকট্রাম বাবদ ব্যয়ের চাপ বেড়েছে অত্যাধিক।
এর ফলে স্পেকট্রাম বাবদ মোবাইল অপারেটরদের ব্যয় এখন তাদের খরচের সর্বোচ্চ একটি অংশ। ২০২৪ সালে অপারেটরদের মোট আয়ের ১৬.৭ শতাংশ খরচ হয়েছে কেবল স্পেকট্রামে। জিএসএমএ-এর পূর্বাভাস অনুযায়ী এ অবস্থা চলতে থাকলে ২০২৭ নাগাদ এটি বেড়ে ২৩ শতাংশে পৌঁছাবে, যা ছোট অপারেটরদের জন্য নিঃসন্দেহে অস্তিত্ব সংকট তৈরি করবে। এমনকি স্পেকট্রাম কেনার মূল্য ৫০ শতাংশ কমালেও অপারেটরদের আয়ের কমপক্ষে ১৬ শতাংশ স্পেকট্রাম বাবদ ব্যয় হবে, যা বিনিয়োগকারী ও শেয়ারহোল্ডারদের জন্যও নেতিবাচক সংকেত।
রবির উদাহরণ ধরলে বিষয়টি আরও স্পষ্ট হয়। কোম্পানিটির মোট বার্ষিক স্পেকট্রাম খরচের প্রায় ২০ শতাংশই শুধু বার্ষিক স্পেকট্রাম ব্যবহারের চার্জ। সরকার যখন স্পেকট্রাম নিলামের মাধ্যমে বিপুল রাজস্ব পেয়েই থাকে, তখন আবার একই সম্পদের ব্যবহারে বার্ষিক ফি ধার্য করার যৌক্তিকতা খুঁজে পাওয়া কঠিন।
আন্তর্জাতিকভাবে পরিস্থিতি ভিন্ন। দক্ষিণ এশিয়াসহ বিশ্বের অধিকাংশ দেশই স্পেকট্রামের ওপর দ্বৈত চার্জ আরোপ করে না। বাংলাদেশে শুরু থেকেই যাদের স্পেকট্রাম নীতিকে অনুসরণ করে–সেই ভারত ২০২২ সালেই বার্ষিক ব্যবহারের চার্জ বাতিল করেছে ২০২১ সালের সেপ্টেম্বরের পর নিলামে নেওয়া স্পেকট্রামের ক্ষেত্রে। কারণ একবার নিলামের মাধ্যমে উচ্চমূল্যে স্পেকট্রাম কিনে নেওয়ার পর আবার বার্ষিক চার্জ আরোপ করা হলে অপারেটরদের বিনিয়োগ সক্ষমতা দুর্বল হয়ে পড়ে, নেটওয়ার্ক বিস্তার ধীরগতি হয়, গ্রাহকসেবার মান কমে আর ডিজিটাল লক্ষ্যও ব্যাহত হয়।
- ট্যাগ:
- মতামত
- স্পেকট্রাম
- ডিজিটালাইজেশন
- টেলিকম খাত