
শিক্ষার গোড়ায় হাত দিতে হবে
গত ১৬ অক্টোবর এইচএসসি পরীক্ষার ফল প্রকাশিত হয়েছে। এবারের ফলাফল দেখে ধাক্কা খেয়েছেন অনেকে। দেখা যাচ্ছে বিগত একুশ বছরের মধ্যে এবারই পাসে হার সর্বনিম্ন। ২০০৫ সালে ৯টি সাধারণ শিক্ষা বোর্ডের পাসে হার ছিল ৫৯ দশমিক ১৬ শতাংশ। আর এবার ৫৭ দশমিক ১২ শতাংশ। মাঝের বছরগুলোতে পাসের হার ৬৫ শতাংশ থেকে ৮০ শতাংশের মধ্যে ওঠানামা করেছে।
এবার মাদ্রাসা বোর্ডে পাসের হার ৭৫ দশমিক ৬১ শতাংশ আর কারিগরি বোর্ডে ৬২ দশমিক ৬৭ শতাংশ। সব বোর্ডের গড় পাসের হার ৫৮ দশমিক ৮৩ শতাংশ। গত বছর যা ছিল ৭৭ দশমিক ৭৮ শতাংশ।
ফলাফলের যে চারটি মূল সূচক রয়েছে, সবগুলোই এবার নিম্নমুখী। পাসের হার কমার পাশাপাশি জিপিএ-৫ প্রাপ্তির সংখ্যাও কমেছে। শতভাগ পাস শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা কমেছে, বেড়েছে শূন্য পাস প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা। পরিসংখ্যানের দিকে তাকালে দেখা যায়, সব বোর্ডের মোট ১২ লাখ ৩৫ হাজার ৬৬১ জন পরীক্ষা দিয়েছে। কিন্তু পাস করতে পারেনি ৫ লাখ ৯ হাজার ৭০১ জন। গত বছর জিপিএ-৫ যেখানে পেয়েছিল এক লাখ ৪৫ হাজার ৯১১ জন এবার সেখানে পেয়েছে মাত্র ৬৯ হাজার ৯৭ জন। শতভাগ পাস প্রতিষ্ঠান গত বছর ছিল এক হাজার ৩৮৮টি, এ বছর মাত্র ৩৪৫টি। শূন্য পাস প্রতিষ্ঠান গতবছর যেখানে ছিল মাত্র ৬৫টি, এ বছর বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২০২টিতে।
শিক্ষা উপদেষ্টা অধ্যাপক সি আর আবরার সচিবালয়ে সংবাদ সম্মেলনে বলেন, এটাই প্রকৃত চিত্র। শিক্ষার্থীরা যা লিখেছে, তার ভিত্তিতে নম্বর দেওয়া হয়েছে—কোনো বাড়িয়ে-কমিয়ে নয়। ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক খন্দকার এহসানুল কবিরও একই কথা বলেন। তিনি এই ফলকে ‘বাস্তবতা’ বলে অভিহিত করে বলেন, “এই বাস্তবতাটা আমাদের সামনে এসে হাজির হয়েছে। আমরা এই বাস্তবতাটা ফ্যাব্রিকেট করিনি।”
যদি তাদের বক্তব্য সঠিক হয়, তাহলে গত বছরগুলোতে ফলাফল ম্যানিপুলেট করা হয়েছে বলে ধরে নিতে হয়। শিক্ষা ক্ষেত্রে এমন তুগলকী কাণ্ড দীর্ঘদিন ধরে চলছে। সি আর আবরারের মতে, খাতা মূল্যায়ন উদার ছিল, এখন কড়া করা হয়েছে। কিন্তু আগামী বছর নতুন উপদেষ্টা এলে যদি আবার নরম করা হয়, তাহলে পাসের হার আবার বাড়বে—এই চক্রই চলছে।
শিক্ষা বিটে কয়েক বছর রিপোর্টার হিসেবে কাজ করার সুবাদে কিছু প্রবণতা লক্ষ করেছি। ২০০৮ সালে শিক্ষা উপদেষ্টা ড. হোসেন জিল্লুর রহমানের আমলে চট্টগ্রাম বোর্ড সবচেয়ে ভালো ফল করে, যা তার নিজের জেলার সুবিধা নিয়ে প্রশ্ন তোলে। পরে সিলেট অঞ্চলের এক সন্তান শিক্ষামন্ত্রী হলে সিলেট বোর্ড শীর্ষে চলে আসে।
ফলাফলের ভালো-মন্দের মাপকাঠি আগের বছরের তুলনায় করা হয়, কিন্তু কেন এমন হয়েছে তা গবেষণার মাধ্যমে খতিয়ে দেখা হয় না। বিশেষজ্ঞদের মতামত গ্রহণ করা হয় না। বেশি পাস দেখানোর মতো ফেল রাখারও কোনো গৌরব নেই। শিক্ষার্থী শিক্ষা ব্যবস্থায় এসেও যথেষ্ট শিক্ষা পায় কিনা, না পেলে দায় কার—শিক্ষার্থী, পরিবার, শিক্ষক, প্রতিষ্ঠান, ব্যবস্থা না রাষ্ট্রের, তা খুঁজে বের করতে হয়। জবাবদিহিতার ব্যবস্থা থাকা দরকার, কিন্তু তা নেই।
বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারে প্রধান উপদেষ্টা, শিক্ষা উপদেষ্টা, প্রাথমিক শিক্ষা উপদেষ্টা সকলেই শিক্ষক। অনেকে আশা করেছিলেন বাজেটে শিক্ষা অগ্রাধিকার পাবে, কিন্তু পায়নি। এখন উপদেষ্টা যা বলবেন, তা কি বিশ্বাসযোগ্য হবে?
এবারের ফলাফল শিক্ষা ব্যবস্থার ভয়াবহ দিকটি তুলে ধরেছে। ঢাকা মহানগরীতে পাসের হার ৮৪ শতাংশ, কিন্তু একই বোর্ডের শরীয়তপুর-গোপালগঞ্জে ৪২ শতাংশ। টাঙ্গাইলে ৪৪, নরসিংদীতে ৬৮ শতাংশ। চট্টগ্রাম মহানগরীতে ৭১, জেলায় ৪৪ শতাংশ। রাজশাহী মহানগরীতে ৯০, কিন্তু পুঠিয়ার পঞ্চমাড়িয়া কলেজে ২৫.১৫ শতাংশ। এতে শিক্ষায় চরম বৈষম্য স্পষ্ট হয়েছে। ঢাকা বোর্ড চেয়ারম্যান স্বীকার করেছেন, সচ্ছল এলাকায় ফল ভালো হয়।
তবে কিছু চমকপ্রদ তথ্যও আছে। ঢাকার নটরডেম কলেজে ৩,২৩৯ জনের মধ্যে ৯৯.৬০ শতাংশ পাস, ২,৪৫৪ জন জিপিএ-৫ পেয়েছে—যা অনেক শিক্ষা বোর্ডের চেয়েও বেশি। ক্যাডেট কলেজগুলোতে ৫৮৯ জনের মধ্যে ৫৮৭ জন জিপিএ-৫ পেয়েছে। এসব দেখায়, ভালো করার উদাহরণ দেশেই আছে।
যারা ফেল করেছে আমরা তাদের নিয়েই কথা বলছি। ১২ লাখের বেশি পরীক্ষার্থীর মধ্যে ৫ লাখের বেশি ফেল, আর ১২ বছর আগে প্রথম শ্রেণিতে ভর্তি হয়ে ঝরে পড়া আরও ১২ লাখের কথা ভাবতে হবে। ভাবতে হবে শিক্ষার আওতায় না আসা শিশুদেরও কথা।