সৌদি-যুক্তরাষ্ট্র দরকষাকষি

দেশ রূপান্তর রায়হান আহমেদ তপাদার প্রকাশিত: ২৩ নভেম্বর ২০২৫, ১৩:১২

সৌদি আরবের ডি-ফ্যাক্টো শাসক ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমান (এমবিএস) গত ১৮ নভেম্বর হোয়াইট হাউসে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। দীর্ঘ সাত বছর পর সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান যুক্তরাষ্ট্র সফরে গিয়েছেন। সেখানে অন্যতম আলোচিত বিষয় হয়ে উঠেছে, সৌদি আরবের এফ-৩৫ যুদ্ধবিমান কেনার চুক্তি। উভয় দেশ একটি যৌথ ঘোষণা স্বাক্ষর করেছে, যার মাধ্যমে সৌদি আরবে শান্তিপূর্ণ পারমাণবিক শক্তি উন্নয়নে যুক্তরাষ্ট্রকে প্রধান অংশীদার হিসেবে নির্ধারণ করা হয়েছে। অন্যদিকে সৌদি আরব যুক্তরাষ্ট্রে প্রায় ১ ট্রিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগ বাড়ানোর ঘোষণা দিয়েছে। এ ছাড়াও বলা হয়েছে, মার্কিন পণ্য রপ্তানি বাড়াতে বাণিজ্য প্রতিবন্ধকতা কমানো হবে।


আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমের তথ্যমতে তেল, নিরাপত্তা, বাণিজ্য, প্রযুক্তি এবং সম্ভাব্য পারমাণবিক জ¦ালানি সহযোগিতাসহ দুই দেশের দীর্ঘদিনের অংশীদারত্ব আরও গভীর করাই ছিল, বৈঠকের প্রধান লক্ষ্য। অন্যদিকে জার্মানভিত্তিক সংবাদমাধ্যম ডয়চে ভেলের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে গাজায় যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় যুদ্ধবিরতির পর এটি দুই নেতার প্রথম মুখোমুখি বৈঠক। মধ্যপ্রাচ্যের অস্থির নিরাপত্তা পরিস্থিতি, ইরানের ওপর আক্রমণ, কাতারে ইসরায়েলি হামলা এবং ইসরায়েল-হামাস সংঘাতের জটিল প্রেক্ষাপটে এই  বৈঠককে চলমান বৈশি^ক রাজনীতির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হিসেবে দেখা হচ্ছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, সফরটি মূলত চারটি অক্ষে আবর্তিত হবে নিরাপত্তা সহযোগিতা, বেসামরিক পরমাণু কর্মসূচি, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও প্রযুক্তি বিনিয়োগ এবং ইসরায়েল-ফিলিস্তিন প্রশ্ন। উভয়পক্ষই চায়, সফর শেষে যেন বড় কোনো চুক্তি বা দৃশ্যমান অগ্রগতি ঘোষণা করা যায়।


যুক্তরাষ্ট্রের চাওয়া হচ্ছে গাজায় যুদ্ধবিরতি বজায় রাখা, হামাসকে নিরস্ত্র করা, ইসরায়েলের সেনা প্রত্যাহার এবং অবকাঠামোগত পুনর্গঠন। এই পুনর্গঠনে সৌদি আরবকে বড় অর্থায়নের অংশীদার হিসেবে দেখতে চায় যুক্তরাষ্ট্র। শুধু তাই নয়, সিরিয়ায় মানবিক সহায়তা ও পুনর্গঠন উদ্যোগেও সৌদির সম্পৃক্ততা ওয়াশিংটনের কাছে গুরুত্বপূর্ণ। আবার সৌদি আরব দীর্ঘদিন ধরে বেসামরিক পরমাণু কর্মসূচি শুরু করতে আগ্রহী। আগের আলোচনায় যুক্তরাষ্ট্র সৌদিকে ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ সীমিতভাবে অনুমোদন দেওয়ার ব্যাপারে বিবেচনা করেছিল। তবে ইরানের সঙ্গে আঞ্চলিক প্রতিযোগিতা এবং সৌদি-পাকিস্তান প্রতিরক্ষা চুক্তির কারণে নতুন প্রশ্ন উঠেছে। সৌদি আরবের যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের গত সাত বছরের যাত্রা ঠিক এমনই এক রূপান্তরের গল্প। বিন সালমানের প্রথম যুক্তরাষ্ট্র সফর থেকে শুরু হওয়া এ যাত্রা যেন, একটি বড় ও ব্যয়বহুল চলচ্চিত্রের মতো। যেখানে রয়েছে ক্ষমতার ঝলক, বড় স্বপ্ন, নানা চক্রান্ত ও সহিংসতার ছাপ। ২০১৮ সালে যুক্তরাষ্ট্রে আসার সময় ক্রাউন প্রিন্স হিসেবে মোহাম্মদ বিন সালমানের পরিচিতি ছিল কঠোর শাসক ও আক্রমণাত্মক পররাষ্ট্রনীতির প্রবক্তা হিসেবে। সেই সময় তাকে ঘিরে ঘটেছিল কিছু উল্লেখযোগ্য ঘটনা।


রিয়াদের রিটজ-কার্লটন হোটেলে তিনি শত শত ধনী ব্যবসায়ী ও রাজপরিবারের সদস্যকে আটক করেছিলেন। ইয়েমেনে হুতিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ তীব্র করায় সেখানে অসংখ্য সাধারণ মানুষ মারা গিয়েছিল। তিনি লেবাননের প্রধানমন্ত্রীকে চাপ দিয়ে পদত্যাগ করাতে বাধ্য করেছিলেন। আর সাংবাদিক জামাল খাসোগির নৃশংস হত্যাকাণ্ড, যা নিয়ে আন্তর্জাতিকভাবে তীব্র সমালোচনা হয়। মানবাধিকার পরিস্থিতি সৌদি আরবে এখনো নিখুঁত নয়। সেখানে রাজনৈতিক মতপ্রকাশ সীমিত এবং বিচারব্যবস্থা পুরনো ও অস্বচ্ছ। সেখানে মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার ঘটনা এখনো ঘটে। কিন্তু সেই সঙ্গে যুবরাজ সালমান এমন কিছু পরিবর্তন এনেছেন, যা একসময় অকল্পনীয় মনে হতো। তিনি ধর্মীয় পুলিশকে কার্যত ক্ষমতাহীন করেছেন এবং এমন আইন বাতিল করেছেন, যা আগে সৌদি নারীদের জীবন কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করত। বিন সালমান আরও বড় পরিবর্তন এনেছেন অর্থনীতি, সংস্কৃতি ও সমাজে। সৌদি অর্থনীতি  বৈচিত্র্যকরণের চেষ্টা চলছে, নবায়নযোগ্য জ¦ালানিতে ব্যাপক বিনিয়োগ হচ্ছে, বিদেশি পর্যটককে স্বাগত জানানো হচ্ছে এবং সংস্কৃতি ও বিনোদনের ক্ষেত্রে অভূতপূর্ব বিস্ফোরণ ঘটেছে। এখন সৌদিতে কনসার্ট, সিনেমা, শিল্প প্রদর্শনী সবই হচ্ছে, যা কয়েক বছর আগে বেআইনি ছিল।


২০১৮ সালে বিন সালমান মনে করেছিলেন, যেহেতু সৌদি আরব নানা দিক থেকে আরব বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী ও প্রভাবশালী দেশ, তাই তিনি চাইলে পুরো অঞ্চলের গতিপথও নির্ধারণ করতে পারবেন। তখন তিনি তরুণ এবং নেতা হিসেবে তুলনামূলকভাবে অনভিজ্ঞ। কিন্তু সেই উচ্চাকাক্সক্ষা সব সময় সফল হয়নি। হুতি বিদ্রোহীরা এখনো পরাজিত হয়নি, বরং ইয়েমেনের বড় অংশে তাদের প্রভাব আছে। লেবাননের প্রধানমন্ত্রীকে অপমান করার পরও সেখানে শিয়া সংগঠন হিজবুল্লাহ আরও শক্তিশালী হয়েছে। বিরোধীদের দমন করার চেষ্টা উল্টো যুক্তরাষ্ট্রের গণমাধ্যম, রাজনীতিক ও জনগণের কাছে ক্রাউন প্রিন্সের সম্পর্কে খারাপ ধারণা তৈরি করেছে। এই অভিজ্ঞতাগুলো থেকে যুবরাজ সালমানকে বুঝতে পেরেছেন, আঞ্চলিক সংঘাতগুলো সহজে সমাধান হয় না। তাই তিনি মনোযোগ ঘুরিয়ে দিয়েছেন নিজের দেশে; অর্থনীতি ও সমাজকে উন্নত করার দিকে। তিনি এই সংঘাতগুলো সৌদি সীমান্ত থেকে দূরে রাখতে চান।


এই আধুনিকায়ন দুটি বিষয়ে নির্ভরশীল, যা পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। প্রথমটি হলো তেলের উচ্চ দাম, কারণ তার প্রকল্পগুলো অত্যন্ত ব্যয়বহুল। দ্বিতীয়টি হলো, সংঘাত না থাকা। কারণ, যদি ইয়েমেন বা ইরান থেকে ক্ষেপণাস্ত্র আসে, তাহলে বিনিয়োগকারী বা পর্যটক সৌদি আরবে আসবেন না। গত এক বছরে দেখা গেছে, এই শর্তগুলো বজায় রাখা কত কঠিন। তেলের দাম কমছে। মার্কিন গাড়িচালক বা প্রেসিডেন্টদের জন্য হয়তো এটি ভালো খবর। কিন্তু যদি লক্ষ্য থাকে তেলনির্ভর অর্থনীতি রূপান্তর করা, উৎপাদন বাড়ানো, শিক্ষা সংস্কার করা বা পর্যটন খাত গড়ে তোলা, তাহলে এটি সালমানের জন্য ভালো খবর নয়। এদিকে আঞ্চলিক সংঘাতও থামছে না। হুতিদের হুমকি আছে, সুদানে ভয়াবহ গৃহযুদ্ধ চলছে এবং ইরান এখনো বড় হুমকি। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, ক্রাউন প্রিন্সের অগ্রাধিকার এখন কোথায়। তিনি আন্তর্জাতিক ব্যবসা ও বিনিয়োগকে আকৃষ্ট করতে চান। তিনি অঞ্চলের অন্তহীন সংঘাতে জড়িয়ে পড়তে চান না। তিনি ইরানের সঙ্গে এক ধরনের সাময়িক সমঝোতা বজায় রাখতে চান। ভূরাজনীতিতে কোনো নিখুঁত নিশ্চয়তা নেই। তবে যুক্তরাষ্ট্রের নিরাপত্তা নিশ্চয়তা একটি ভালো শুরু হতে পারে।

সম্পূর্ণ আর্টিকেলটি পড়ুন

প্রতিদিন ৩৫০০+ সংবাদ পড়ুন প্রিয়-তে

আরও