
নারীর চরিত্র নির্ণয় দুই আঙুলে?
যে সমাজে মানুষ চাঁদে পা রেখেছে, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তায় ভবিষ্যৎ গড়ে তুলছে—সেই সমাজেই এখনো একটি মেয়ে ধর্ষণের শিকার হলে তার যন্ত্রণার মূলে থাকে এক লজ্জাজনক ও মধ্যযুগীয় অধ্যায়, যার নাম হলো ‘টু ফিঙ্গার টেস্ট’। চিকিৎসার নামে এমন একটি পরীক্ষা, যেখানে ভিকটিমের সম্মান, তার শারীরিক গোপনীয়তা ও তার মনোজগতের ওপর চালানো হয় দ্বিতীয়বারের মতো চরম আঘাত। আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানের যুগে এ পদ্ধতির কি কোনো বৈজ্ঞানিক, সামাজিক বা নৈতিক বৈধতা আছে?
টু ফিঙ্গার টেস্ট এমন এক চিকিৎসা পদ্ধতি যেখানে ধর্ষণের শিকার নারীর যোনিপথে চিকিৎসক আঙুল প্রবেশ করিয়ে পরীক্ষা করেন, ‘তার পূর্ববর্তী যৌন অভিজ্ঞতা’ বা ‘তার হাইমেন অক্ষত আছে কি না’। এই তথাকথিত পরীক্ষা নির্ভর করে পুরোনো ও পুরুষতান্ত্রিক এক বিশ্বাসের ওপর, যা ধর্ষণকে শারীরিক আঘাতের প্রমাণ দিয়ে বিচার করে, মনস্তাত্ত্বিক ক্ষত বা সম্মতির গুরুত্ব একেবারেই অস্বীকার করে। ভুক্তভোগীকেই কেন এ ন্যক্কারজনক অপমান করা হয়?
ধর্ষণের শিকার হওয়া এক নারীর প্রথম প্রয়োজন নিরাপত্তা, চিকিৎসা ও সহানুভূতি। অথচ সেই সময় তাকে নিয়ে যাওয়া হয় হাসপাতালে, যেখানে এই পরীক্ষার নামে ফের একবার তাকে মনে করিয়ে দেওয়া হয়- তুমি নারী, তুমি ‘পবিত্র’ ছিলে কি না, সেটাই মূল প্রশ্ন! এই প্রথা মূলত নারীর শরীর ও তার যৌনতা নিয়ে একটি পুরোনো কুসংস্কারের ধারক। ধর্ষণের জন্য দায়ী যে পুরুষ, তাকে নিয়ে প্রশ্ন নয়, উল্টো নির্যাতিতা নারীর ওপরই পড়ে প্রমাণের ভার!
এ বিষয়ে আদালত ও মানবাধিকার সংস্থা ২০১৩ সালে ভারতের সুপ্রিম কোর্ট ‘টু ফিঙ্গার টেস্ট’-কে অবৈধ ঘোষণা করে বলে, এটি মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন। বাংলাদেশেও উচ্চ আদালত এ ধরনের পরীক্ষার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। ২০২১ সালে বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিল এই পরীক্ষার বৈজ্ঞানিক ভিত্তিহীনতা ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের কথা উল্লেখ করে নিষিদ্ধ করার সুপারিশ করে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, এখনো দেশের কিছু অঞ্চলে এই পদ্ধতি প্রয়োগ করা হয়- আইনের অভাবে নয়, বরং সচেতনতার ঘাটতিতে, যা মানসিক সহিংসতার এক অব্যক্ত রূপ বলা যায়।
ধর্ষণের শিকার হওয়া নারী কেবল শরীরিকভাবে নয়, সবচেয়ে বেশি ভেঙে পড়ে মানসিকভাবে। সে যখন সাহস করে ধর্ষণের ঘটনা জানাতে আসে, তখনই আমাদের সমাজের ব্যবস্থাটি তাকেই প্রথমে সন্দেহ করে, তারপর পরীক্ষা করে আর শেষে প্রশ্ন করে- ‘তুমি আগে কতবার শারীরিক সম্পর্ক করেছ?’ টু ফিঙ্গার টেস্ট তাই ধর্ষকের পর দ্বিতীয় আঘাত, যা সমাজ ও চিকিৎসক একত্রে দেয় ‘প্রথা’র নামে। এমন এক দেশে, যেখানে নারীর শরীর এখনো যৌনতার মানদণ্ডে মাপা হয়, সেখানে এই পরীক্ষার ছুঁতোয় চলে এক ধরনের মানসিক ধর্ষণ। এরকম নোংরা প্রথা আর কতদিন চলবে? নারী কি কেবল ‘হাইমেন’?
টু ফিঙ্গার টেস্ট মূলত এক ধরনের কুসংস্কারপ্রসূত পরীক্ষা, যার ভিত্তি পড়ে আছে নারীর হাইমেন বা কুমারিত্ব নিয়ে সামাজিক মোহে। অথচ আধুনিক চিকিৎসা বলে, হাইমেন ছিঁড়ে যেতে পারে খেলাধুলা, সাইকেল চালানো বা অনিয়মিত মাসিকের কারণেও। অর্থাৎ ধর্ষণের প্রমাণ হাইমেন দিয়ে নয়, ঘটনাপ্রবাহ, ফরেনসিক প্রমাণ ও মানসিক অবস্থা দিয়ে হয়। তাহলে প্রশ্ন ওঠে, এই পুরোনো ধারণা ধরে রেখে আমরা কাদের সন্তুষ্ট করছি? নাকি আমরা এখনো নারীকে মালিকানার বস্তু হিসেবেই দেখে যাচ্ছি?
নারী সাক্ষ্য নয়, সম্মান চায়। যে মেয়ে ভয়, লজ্জা এবং সামাজিক অপবাদ উপেক্ষা করে থানায় বা হাসপাতালে যায়, তার কাছে টু ফিঙ্গার টেস্ট মানে এক ভীতিকর নতুন অধ্যায়। সে চায় বিচার, কিন্তু পায় অনৈতিক পরীক্ষা। সে চায় বিশ্বাস, পায় সন্দেহ। ধর্ষণের শিকার নারীকে সাক্ষ্য দিতে হয় না, তাকে সম্মান জলাঞ্জলি দিতে হয়। তার সম্মতি, তার কথা, তার অভিজ্ঞতাই হওয়া উচিত মূল প্রমাণ। পুরুষতন্ত্রের ছদ্মবেশী পদ্ধতি আর কতদিন চলবে?
টু ফিঙ্গার টেস্ট আসলে এক ধরনের ছদ্মবেশী পুরুষতন্ত্র, যা চিকিৎসার আড়ালে নারীর চরিত্র যাচাই করে। ধর্ষণ হয়েছে কি না, তার চেয়ে বেশি গুরুত্ব পায়—নারী ‘শুদ্ধ’ ছিল কি না! এক ধরনের ‘victim blaming’ চালানো হয় এই পরীক্ষার মাধ্যমে। অথচ কোনো পুরুষ ধর্ষণের অভিযোগ পেলে তার ‘কুমারিত্ব’ পরীক্ষা হয় না- কারণ আমাদের সমাজে চরিত্র প্রশ্নবিদ্ধ হয় একমাত্র নারীর! আসলে এদেশে আইন আছে, কিন্তু প্রয়োগ কোথায়?
- ট্যাগ:
- মতামত
- ধর্ষণের শিকার
- মেডিকেল টেস্ট