
রাজনৈতিক বিভক্তিই এখন বড় সংকট
নির্বাচন এ বছরের ডিসেম্বরে হবে, নাকি পরের বছর জুনের ভেতর হবে এ বিষয়টি এখনো পরিষ্কার নয়। বিএনপিসহ বেশ কিছু রাজনৈতিক দল দ্রুত নির্বাচন অনুষ্ঠানের পক্ষে। সাম্প্রতিক সময়ে বিএনপির সব বক্তব্য এবং আলোচনার মূল প্রসঙ্গ হলো নির্বাচন। এর আগে তারা জানিয়েছিল ডিসেম্বরে নির্বাচন না হলে তারা কঠোর কর্মসূচি দেবে।
সে রকম কঠোর হুঁশিয়ারি থেকে সরে এসেছে। তবে তাদের সব রাজনৈতিক সভায়-আলোচনায় বিষয়টি সবচেয়ে বেশি আলোচিত হচ্ছে। দেশের বিশিষ্ট ব্যক্তিরাও বলছেন, সরকারের উচিত এ বছরের মধ্যেই নির্বাচন দিয়ে দেওয়া। এর আগে সেনাপ্রধান এক সাক্ষাৎকারে নির্বাচনের জন্য ১৮ মাস সময়ের কথা বলেছিলেন।
কিন্তু সময় কমে আসছে। সরকারের দিক থেকে সংস্কার এবং নির্বাচন প্রসঙ্গে একটি মাঝামাঝি অবস্থান লক্ষ করা যাচ্ছে।
আসন্ন নির্বাচনে নির্বাচনব্যবস্থায় কতটা পরিবর্তন আসবে সে বিষয়ে রাজনৈতিক দল, নির্বাচন কমিশন, জাতীয় ঐকমত্য কমিশন এখনো অন্ধকারে। ভোটাররাও জানেন না এবারের নির্বাচনে ব্যবস্থা ও পদ্ধতিগত কী কী পরিবর্তন আসছে।
আবার এটিও বড় প্রশ্ন যে পরিবর্তন হলেই কি সেটি স্থায়ী হবে? এর আগেও নির্বাচনসংক্রান্ত বেশ কিছু বিধি-বিধান আরপিওতে যুক্ত করা হয়েছিল। পরবর্তী সময়ে নির্বাচিত সরকার এসে সেগুলো বাতিলও করেছিল। শুধু বাংলাদেশে নয়, সারা বিশ্বে গণতন্ত্রের অন্যতম একটি নির্ধারক হিসেবে নির্বাচন প্রসঙ্গে নানা ধরনের সমস্যা রয়েছে। বাংলাদেশও এর বাইরে নয়।
কয়েক বছর আগে নির্বাচনী আচরণ এবং প্রচারণা নিয়ে একটি গবেষণা করেছিলাম।
উক্ত গবেষণাপত্রটি উপস্থাপনের জন্য তুরস্ক গেলাম। সেখানে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের নির্বাচন, রাজনীতি এবং গণতন্ত্রের আদ্যোপান্ত নিয়ে বিভিন্ন ধরনের গবেষণাপত্র উপস্থাপিত হয়। বিভিন্ন দেশ থেকে আসা গবেষকরা তাঁদের গবেষণাপত্রে বিশ্বব্যাপী নির্বাচন ও রাজনীতির গতি-প্রকৃতি তুলে ধরেন। সেখানে লক্ষ করা যায় যে সংশ্লিষ্ট রাষ্ট্রগুলোতে নির্বাচনের ধরন ও প্রক্রিয়া রাজনীতির গতি-প্রকৃতির ওপর প্রভাব বিস্তার করে। এমনকি ওই সব গবেষণাপত্রে নির্বাচন ও গণতন্ত্রে অর্থের প্রভাব এবং এ বিষয়ে সহিংসতা সৃষ্টি ও আস্থা-অনাস্থার তথ্য উঠে আসে। উল্লিখিত সম্মেলনে পরিষ্কারভাবে একটি সংশ্লেষণ তৈরি হয় যে নির্বাচনের সঙ্গে সেই দেশের রাজনীতি এবং সহিংসতার নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে এবং সেটি গোটা বিশ্বব্যাপী।
বর্তমানে বিশ্বব্যাপী গণতন্ত্র এবং নির্বাচন খুব বেশি অলোচিত শব্দযুগল। যেকোনো দেশের নির্বাচন প্রক্রিয়ার ধরন এবং প্রকৃতি রাজনীতির গতি নির্ধারণ করে থাকে। এককথায় বলা যায় নির্বাচন রাজনীতিকে প্রভাবিত করে। নির্বাচন নিয়ে সংঘর্ষ এবং হিংসাত্মক কর্মকাণ্ড যেন একটি অঙ্গাঙ্গি বিষয় হয়েও দাঁড়িয়েছে গোট বিশ্বব্যাপী। এ প্রসঙ্গে সারা বিশ্বের চিত্র প্রায় কাছাকাছি এবং অনেকটা একই। এই কর্মকাণ্ড যখন ভয়ংকর পর্যায়ে পৌঁছে যাচ্ছে তখন আমরা শঙ্কিত হয়ে উঠছি। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে, ক্ষমতাসীন দল যদি মনে করে নিয়ন্ত্রণহীন সুষ্ঠু নির্বাচনে তাদের পরাজিত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে, তখন তারা প্রকাশ্যে কিংবা গোপনে নানা অজুহাতে সংঘর্ষ ও সংঘাত সৃষ্টি করে ভীতির রাজ্য কায়েম করার চেষ্টা করছে—এমন অসংখ্য নজির রয়েছে। এর সঙ্গে তারা তৈরি করে বেশ কিছু আইন-কানুন, যা দিয়ে ক্ষমতা আঁকড়ে থাকা যায়।
বিশ্বের বহু দেশে নির্বাচনী সংস্কার হয়েছে। রাজনৈতিক দলগুলো বারবার কমিটমেন্ট করছে- নির্বাচনকে অবাধ ও গ্রহণযোগ্য করে তোলার বিষয়ে। তার পরও কোনো না কোনোভাবে নির্বাচন প্রভাবিত হচ্ছে এবং প্রশ্নবিদ্ধও হয়েছে। বর্তমান সময়ে কাঙ্ক্ষিত পর্যায়ের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় নির্বাচন কতটুকু ভূমিকা রাখছে সেটি এখন অধিকভাবে ভেবে দেখার সময় এসেছে।
এমনকি এ কথা বললে ভুল হবে না যে বিশ্বব্যাপী রাজনীতি বিজ্ঞান ক্রমেই জটিল হচ্ছে। এ বিষয়ে বিস্তর হোমওয়ার্ক প্রয়োজন। মিডিয়া আগের চেয়ে অনেকটাই সক্রিয়। রাজনীতির সবটাই দেখছে এখন মিডিয়া। শাসকবিরোধী লড়াই কিংবা কোন রাজনীতিক হাতে কোন ব্র্যান্ডের ঘড়ি পরছেন-সবটাই দেখছে মিডিয়া এবং তা প্রচার করছে। তাই রাজনীতির হিসাবটা আরো কঠিন হয়েছে। অতীত-বর্তমান ঘেঁটে বের করে আনতে হয় বিরোধীপক্ষের দুর্বল জায়গা। তারপর প্রস্তুতি নিয়ে আঘাত করতে হয় সেখানে। অক্লান্ত প্রক্রিয়া, থেমে থাকার পথ নেই। একজন যে রাজনৈতিক ক্রিয়া করবে, অন্যজন ঠিক তার বিপরীত প্রতিক্রিয়ার জন্য প্রস্তুতি নিয়ে রাখবে। কারণ ক্রিয়ার পরেই প্রতিক্রিয়ার উদ্ভব হবে।