পান্থকুঞ্জ রক্ষা আন্দোলন– পরিবেশ-বার্তাকে সামাজিক সংগ্রামে রূপান্তর

বিডি নিউজ ২৪ পাভেল পার্থ প্রকাশিত: ২৩ মার্চ ২০২৫, ২০:৫৩

মুক্তবিশ্বকোষ নামে পরিচিত ‘উইকিপিডিয়া’তে পরিবেশ আন্দোলন নিয়ে বাংলাদেশ বিষয়ক অংশটুকু পড়লে যে কেউ ভিমরি খাবে। বাংলাদেশের পরিবেশ আন্দোলন নিয়ে এই মার্চের ২০ তারিখে দেখা উইকিপিডিয়ার বয়ানের ভেতর দিয়ে দেখি তাদের অতি দুর্বল গবেষণা এবং অমনোযোগী অসতর্ক আচরণ।এক টিপাইমুখ বাঁধ বিরোধিতাকে ‘উইকি’ বাংলাদেশের পরিবেশ আন্দোলন হিসেবে উল্লেখ করে কী বার্তা দিতে চায়?


দুইশ বছর ধরে যে ভূগোল পরিবেশ আন্দোলন করছে, দুনিয়ার আদি পরিবেশ-বার্তাকে সামাজিক সংগ্রামে রূপ দিয়েছে, সেইসব ইতিহাস পরিবেশনে অবশ্যই সৎ, সতর্ক এবং দায়িত্বশীল থাকা উচিত। বাংলাদেশের মানুষ হাতিখেদা বিরোধী বিদ্রোহ করছে। ১৮০০ থেকে ১৮৩০ পর্যন্ত এই লড়াই চলছে। বনের হাতি ধরে বাণিজ্য করার বিরুদ্ধে গ্রামের পর গ্রাম মানুষ আন্দোলন করেছে। নেত্রকোণার সুসং দুর্গাপুরে বনের হাতি বাঁচাতে গিয়ে হাজং মনা সর্দার, রতিয়া হাজং, বিহারী হাজং, জগ হাজং, সোয়া হাজং শহীদ হয়েছেন। হাতি ব্যবসায়ী রাজা তাদের পিষে মেরে ফেলেছিলেন। বনের হাতি বাঁচাতে জীবন দেয়া এই পরিবেশ-শহীদদের ভুলে গেলে চলবে না আমাদের।


নিম্নবর্গের পরিবেশ-বীক্ষা ব্রিটিশ উপনিবেশকালে বহু লড়াই সংগ্রামের ভিত গড়েছিল। ষাটের দশকে রাষ্ট্রের বহু জুলুমকে পরিবেশ-আয়নায় আরও প্রবলভাবে পাঠ করা শুরু করে গ্রামীণ নিম্নবর্গ। কিন্তু এসব পরিবেশ আন্দোলনের কোনো হদিশ রাষ্ট্র বা এজেন্সি রাখেনি। কারণ গরিব মেহনতি মানুষের রক্তদাগের খতিয়ান লেখা বা বলার মতো কোনো ইতিহাস-প্রকল্প গড়ে তোলা হয়নি। কারণ এই দেশে ইতিহাস বানায় বড়লোক বাঙালি ব্যাটারা। আর কিছু একাডেমিক এবং এলিটদের নুনের ছিটা থাকে। তাই দেখা যায় বালিশিরা পাহাড় আন্দোলন (১৯৬৩), কাপ্তাই বাঁধ বিরোধী আন্দোলন (১৯৬০) কিংবা মহিমাগঞ্জ সুগারমিলের আগ্রাসন থেকে জমি-জলা রক্ষা আন্দোলন (১৯৬২) আমাদের জাতীয় ইতিহাস হয়ে ওঠে না। বালিশিরা পাহাড় বাঁচাতে গিয়ে ৮০ বছরের প্রবীণ কৃষক গণু মিয়া আর ১৯ বছরের তরুণ সালিক মিয়া শহীদ হয়েছিলেন। আমাদের ঐতিহাসিক সব পরিবেশ-সংগ্রামের কথা আমাদের মনে রাখতে হবে। বৃহৎ বাঁধের মাধ্যমে নদীপ্রবাহ হত্যার বিরুদ্ধে মাওলানা ভাসানীর ফারাক্কা বিরোধী আন্দোলনের কথা আমাদের বলতে হবে। ভাসান পানি আন্দোলনের বরুণ রায় ও লালমোহন রায়দের অবদানকে স্বীকৃতি দিতে হবে। ঘুঘুদহ কিংবা ভবদহ বিল রক্ষার আন্দোলন সকল শ্রেণি-বর্গকে একত্র করেছিল। চিংড়িঘেরের আগ্রাসন থেকে জীবন জনপদ বাঁচাতে শহীদ হয়েছেন জায়েদা ও করুণাময়ী সর্দার। মেনকীফান্দা, ইকোপার্ক বিরোধী আন্দোলন, ফুলবাড়ী আন্দোলন থেকে শুরু করে সহস্র পরিবেশ জনসংগ্রাম বাংলাদেশের পরিবেশ-আন্দোলনের ভিত মজবুত করে চলেছে। এই ধারাবাহিকতায় সমকালে রাসায়নিক দূষণ, প্লাস্টিক দূষণ, বায়ু দূষণ, দখল, ইকোসাইড, উদ্যান-পার্ক রক্ষা, পরিবেশ ব্যক্তিসত্তার স্বীকৃতি কিংবা জলবায়ু ন্যায্যতার আন্দোলনগুলো নানাভাবে দানা বেঁধেছে।



প্রায় একশ দিন ধরে পান্থকুঞ্জ পার্ক ও হাতিরঝিল রক্ষায় ঢাকায় একটি আন্দোলন চলছে, যা বিগত বহু পরিবেশ আন্দোলন থেকে নানাভাবেই ভিন্ন। কারণ একশ দিন ধরে কিছু তরুণ পরিবেশকর্মী, শিল্পী ও সংগঠক পান্থকুঞ্জ পার্কে অবস্থান করে এই লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন। এর ভেতর একটি নতুন বছর এসেছে। তীব্র শীতকাল গিয়ে তাপদাহের কাল আসছে। মশা, শব্দ, ধূলি ও বায়ু দূষণের প্রচণ্ড উৎপাতের ভেতরেও তরুণেরা মুমূর্ষু পান্থকুঞ্জ পরিষ্কার করেছেন। যথাসাধ্য প্লাস্টিক ও আবর্জনামুক্ত করেছেন। শাকসবজি চাষ করেছেন।বীজ বুনেছেন, চারা রোপণ করেছেন। শিল্পী ও সংস্কৃতিকর্মীরা গড়েছেন পরিবেশবান্ধব নানা স্থাপনাশিল্প।


‘বাংলাদেশ গাছ রক্ষা আন্দোলন’ এই আন্দোলনের মূল সমন্বয়ক। বিভিন্ন সামাজিক-পরিবেশ-সাংস্কৃতিক-পরিকল্পনা-পেশাজীবী-সাংস্কৃতিক সংগঠন সংহতি জানিয়েছে। পরিবেশকর্মী, নগর পরিকল্পনাবিদ, সমাজকর্মী, গবেষক, এলাকাবাসী, স্থপতি, প্রকৌশলী, সংস্কৃতিকর্মী, ছাত্র-তরুণ-জনতাসহ নানা শ্রেণি-বর্গের মানুষ নানাভাবে পান্থকুঞ্জ আন্দোলনে যুক্ত হয়েছেন। বহু মানুষ বিশেষত স্থপতি, পরিকল্পনাবিদ ও প্রকৌশলীরা এই আন্দোলনের দাবির পক্ষে লিখেছেন। কিন্তু নিদারুণ সত্য হলো আন্দোলনের শতদিনেও রাষ্ট্র পান্থকুঞ্জ ও হাতিরঝিলের প্রতি দরদী হয়নি। অথচ জুলাই অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে দায়িত্ব পাওয়া অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে দেশবাসীর প্রত্যাশা অনেক।


পান্থকুঞ্জ রক্ষা আন্দোলনের শুরুর দিকে ২০২৪ সালের ২৩ ডিসেম্বর সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়, পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন এবং পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় এবং গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের তিন উপদেষ্টা পান্থকুঞ্জ পার্কে এসে আন্দোলনকারীদের সাথে কথা বলেন এবং বিষয়টি সুরাহার জন্য দ্রুততম সময়ে একসাথে বসার প্রতিশ্রুতি দেন। কিন্তু তিন মাস গত হলো একসাথে বসার সময় হলো না। পান্থকুঞ্জ আন্দোলন আর স্রেফ একটি উদ্যান বা জলাধার বাঁচানোর দাবি হিসেবে রইল না। উন্নয়নের মেগা সুড়ঙ্গ খনন করে তরুণরা সামনে আনা শুরু করলেন মুনাফা আর বাণিজ্যের লোভ, জালিয়াতি আর কর্তৃত্ব কিংবা বিনিয়োগ রাজনীতির অমীমাংসিত সব প্রশ্ন। রাষ্ট্রের উন্নয়ন-দর্শনকে নানাভাবে নাগরিকবর্গ প্রশ্ন করা শুরু করলেন। শততম দিনেও আস্থা হারায়নি পান্থকুঞ্জের শক্তি, আস্থা রাখছে রাষ্ট্র পান্থকুঞ্জ ও হাতিরঝিল আগলে দাঁড়াবে।

সম্পূর্ণ আর্টিকেলটি পড়ুন

প্রতিদিন ৩৫০০+ সংবাদ পড়ুন প্রিয়-তে

আরও