জাতি ও শ্রেণির প্রশ্নে বিভক্ত সমাজ

কালের কণ্ঠ সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী প্রকাশিত: ১৮ মার্চ ২০২৫, ০৯:৪৭

জাতি ও শ্রেণির প্রশ্নে উপমহাদেশে এবং বাংলাদেশেও আমরা চার ধরনের চিন্তা ও দুশ্চিন্তার তৎপরতা দেখি। প্রথমটি জাতীয়তাবাদী, দ্বিতীয়টি উদারনৈতিক, তৃতীয়টি ধর্মীয় মৌলবাদী এবং ৪ নম্বরটি সমাজতান্ত্রিক। এদের ভেতর বিরোধ আছে, কিন্তু স্বল্প সন্ধানেই ধরা পড়বে যে মস্ত মতপার্থক্য থাকা সত্ত্বেও প্রথম তিনটি একই ধারার এবং চতুর্থটি সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রকারের। জাতীয়তাবাদী, উদারনৈতিক ও ধর্মীয় মৌলবাদীরা একে অপরের থেকে দূরেই থাকে, মৌলবাদীরা তো অপর দুই পক্ষ থেকে খুবই দূরের, কিন্তু তবু অন্তর্গতভাবে তিন ধারাই এক ধারা এই অর্থে যে তিনটিই পুঁজিবাদে বিশ্বাসী।

পুঁজিবাদের ভেতরের খবরটি হলো সম্পত্তির ব্যক্তিমালিকানায় বিশ্বাস। সমাজতন্ত্র নানা রকমের হয় বলে প্রচার করা হয়ে থাকে, কিন্তু ওই মতবাদের কেন্দ্রে আছে ব্যক্তিমালিকানার পরিবর্তে সামাজিক মালিকানা প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার। সমাজতান্ত্রিক ধারাটি তাই অন্য তিন ধারার কেবল প্রতিপক্ষই নয়, শত্রুপক্ষও বটে। অন্যরা চায় শ্রেণিব্যবস্থাকে কোনো না কোনোভাবে রেখে দিতে, সমাজতন্ত্রীরা চায় সেটিকে ভেঙে ফেলতে। মিলনের কোনো সুযোগই নেই।


জাতীয়তাবাদের বিভিন্ন প্রকাশ ঘটে। তবে প্রধান প্রকাশ দুই রকমের—একটি আগ্রাসনের, অপরটি আত্মরক্ষার। ব্রিটিশ ভারতে ব্রিটিশের জাতীয়তাবাদ ছিল আগ্রাসনের, লক্ষ্য ছিল লুণ্ঠন; আর যে ভারতবর্ষীয়রা ব্রিটিশকে বিতাড়িত করে স্বাধীন হতে চাইছিল, তাদের জাতীয়তাবাদটি ছিল আত্মরক্ষার।

পার্থক্যটি স্পষ্ট, কিন্তু মিলটি এখানে যে দুই পক্ষের কোনোটিই পুঁজিবাদে অবিশ্বাসী ছিল না, শত্রু-মিত্র উভয় পক্ষই ছিল পুঁজিবাদী। ব্রিটিশরা এসেছিল সম্পদ লুণ্ঠন করে নিজেদের দেশে নিয়ে যাবে এই ইচ্ছায়, এখানে তারা ছিল আগ্রাসী জাতীয়তাবাদী। আর স্বাধীনতার জন্য যে জাতীয়তাবাদীরা লড়ছিল, তারা চাইছিল দেশের সম্পদ দেশে রাখবে। তবে সে সম্পদ যে সবার সমান অধিকারে থাকবে, তা নয়। তাদের দ্বারা যে জাতীয়তাবাদী রাষ্ট্রটি প্রতিষ্ঠিত হবে, তাতে শ্রেণিব্যবস্থা অক্ষুণ্ন থাকবে; যার অর্থ হলো যারা ধনী, তারা সুযোগ পাবে আরো ধনী হওয়ার।




আর যারা দরিদ্র, তারা যদি দরিদ্রতর হতে থাকে। তবে সেটি নিয়ে দুঃখ প্রকাশ চলবে, তবে ব্যবস্থাটিকে ভাঙা চলবে না। মূল লড়াইটি আসলে ছিল দখলদার বিদেশি পুঁজিবাদীদের সঙ্গে উঠতি দেশি পুঁজিপন্থীদের।


দেশীয় জাতীয়তাবাদীদের ভেতরে সশস্ত্র বিপ্লবীরা ছিল। বিপ্লবী তারা এই অর্থে যে অহিংস নয়, সশস্ত্র; নইলে অহিংস গান্ধীবাদীদের সঙ্গে তাদের মৌলিক কোনো বিরোধ নেই। কারণ গান্ধীবাদীদের মতো তারাও ব্যক্তিগত সম্পত্তির পবিত্রতায় আস্থা রাখত। গান্ধী নিজে বিলাসিতাকে ঘৃণা করতেন, বস্তিতে থাকতে তাঁর অসুবিধা হতো না, কিন্তু তাঁর কাঙ্ক্ষিত রামরাজ্যে ব্যক্তিগত সম্পত্তি থাকবে না এমন অলক্ষুনে চিন্তাকে তিনি কখনো প্রশ্রয় দেননি। তিনি কংগ্রেসেরই নেতা। কংগ্রেসকে তিনি জনগণের কাছে নিয়ে গেছেন, কিন্তু জনগণের স্বার্থে নয়। কংগ্রেস ছিল বিত্তবানদের দল, তিনি তাদের স্বার্থই দেখতেন। শ্রমিক ও কৃষকরা রাজনৈতিকভাবে সংগঠিত হোক, এটিও তাঁর কাম্য ছিল না। সমাজতন্ত্রীরা তখনো প্রবল হননি, কিন্তু ওই উঠতি সমাজতন্ত্রীরাও তাঁকে প্রীত করেনি, বিরক্তই করেছে। ওদিকে সহিংস বিপ্লবীরাও সমাজব্যবস্থার পরিবর্তন চায়নি, তারা সনাতন ধর্মের পুনরুজ্জীবনে বিশ্বাস করত। এই বিপ্লবীদের অনেকেই আন্দামানে নির্বাসিত হয়েছিল। ১৯৩৭ সালে মুক্তি পেয়ে তাদের কেউ কেউ কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দিয়েছিল। তাদের কথা আলাদা। বলা যায়, তারা একটি সমুদ্র পাড়ি দিয়েছিল, যে কাজটি অন্যরা করতে পারেনি।


জওয়াহেরলাল নেহরু তাঁর আত্মজীবনীতে লিখেছেন যে একসময় তিনি প্রায় কমিউনিস্টই হয়ে যাচ্ছিলেন, হতে পারলেন না। কারণ টের পেয়ে গেলেন যে কমিউনিস্টরা যথেষ্ট ভারতীয় নয়। দেখা যাচ্ছে, জাতীয়তাবাদ কতটা প্রভাব ফেলেছিল তাঁর ওপর; আর ওই জাতীয়তাবাদের কারণেই তিনি বাপুজির সঙ্গেই রয়ে গেলেন, যে বাপুজি আবার তাঁর নিজের পাশে রাখতেন বড় শিল্পপতি ঘনশ্যামদাস বিড়লাকেও। কমিউনিস্টদের শ্রেণিসংগ্রাম বাপুজির অনুসারী নেহরুর পছন্দ হওয়ার কথা নয়। নেহরু বছরের পর বছর কারাযন্ত্রণা ভোগ করতে পেরেছেন, তাই বলে শ্রেণিচ্যুত হয়ে যাবেন এবং সামাজিক বিপ্লবের পক্ষে লড়বেন—এমনটি তাঁর পক্ষে কোনোভাবেই সম্ভব ছিল না। তাঁর রাজনীতি বুর্জোয়া গণতন্ত্রীরই। তাঁর শাসনামলে কমিউনিস্টরা যে সুবিধায় ছিল তা নয়, খুব অসুবিধায়ই ছিল।


স্বাধীনতার প্রশ্নে নেহরুর তুলনায় সুভাষচন্দ্র বসু ছিলেন অনেক বেশি অনমনীয়। গান্ধীর নেতৃত্বকে আপসকামী মনে করে সেটিকে পরিত্যাগ করে তিনি চলে গিয়েছিলেন সামরিক অভিযানের মধ্য দিয়ে ব্রিটিশ আধিপত্যের অবসান ঘটানোর পথে। সুভাষ বসু সমাজতন্ত্রের কথা ভাবতেন এবং ভারতবর্ষের সমস্যার পথ যে সমাজতান্ত্রিক, সেটিও মানতেন। কিন্তু তিনিও জাতীয়তাবাদীই ছিলেন; নেহরুর চেয়ে কম নয়, বরং বেশিই। তাই দেখি তিনি কংগ্রেস ছেড়ে ফরওয়ার্ড ব্লক গড়ছেন ঠিকই, কিন্তু ফরওয়ার্ড ব্লক কংগ্রেসের ভেতরই থেকে যাচ্ছে। গান্ধীকে ‘জাতির পিতা’ উপাধি তাঁরই দেওয়া। সে জন্য এটি অস্বাভাবিক ছিল না যে সমাজতন্ত্রকে তিনি ভারতবর্ষীয় রূপ দিতে চাইবেন। তাঁর মতে, রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দের ‘সমাজতান্ত্রিক’ পথটিই ছিল সঠিক, মার্ক্স-এঙ্গেলসের পথের তুলনায়। অর্থাত্ সমাজতন্ত্র থাকবে আবার ব্যক্তিমালিকানারও অবসান ঘটবে না। মালিকের সঙ্গে শ্রমিকের যে বিরোধ অনিবার্য ছিল, সেখানে তাঁর প্রবণতা মালিকের দিকেই ঝোঁকার। ঝুঁকেছেন যে তার দৃষ্টান্তও রয়েছে।

সম্পূর্ণ আর্টিকেলটি পড়ুন

প্রতিদিন ৩৫০০+ সংবাদ পড়ুন প্রিয়-তে

আরও