দূষণ কমাতে মানবসৃষ্ট উৎস নিয়ন্ত্রণ প্রয়োজন

কালের কণ্ঠ বিধান চন্দ্র দাস প্রকাশিত: ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৫:৩৫

উত্তর গোলার্ধের অনেক জায়গায় এখন শীতকাল চলছে। বিশ্ব পরিসংখ্যান অনুসারে, শীতকাল অর্থাৎ শীত ঋতু হচ্ছে মানুষের কাছে সব থেকে অপছন্দের ঋতু। উইলিয়াম শেকসপিয়ার তার ‘লাভার্স লেবার্স লস্ট’ নাটকে শীতের শারীরিক কষ্ট চিত্রায়িত করেছেন। প্রাচীন বাংলা সাহিত্যেও শীতকাল কখনো প্রকৃতির শীতল রূপ কিংবা কখনো মানবজীবনের দুঃখ-কষ্টের প্রতীক হিসেবে চিত্রিত হয়েছে।

চর্যাপদ থেকে শুরু করে মধ্যযুগীয় সাহিত্য ও লোকগীতিতে শীতকালীন দুর্ভোগের চিত্র বাংলার কৃষিজীবী ও শ্রমজীবী সমাজের বাস্তবতাকে গভীরভাবে ফুটিয়ে তুলেছে। চর্যাপদ ৮ কাহ্নপাতে পাওয়া যায় : ‘হিমমতী পবন বহে/কায় পিঞ্জর মর্ম জ্বলে।’ এখানে শীতল বাতাসের তীব্রতায় শরীর কাঁপতে থাকা এবং অন্তরের যন্ত্রণার কথা বলা হয়েছে। এটি দারিদ্র্যের শীতকালীন সংগ্রামের এক বাস্তব চিত্র।


পরিবেশবিজ্ঞানীদের দৃষ্টিতে শীতকাল অর্থাৎ শীত ঋতু হচ্ছে পরিবেশদূষণের জন্য সহায়ক একটি ঋতু। প্রকৃতপক্ষে শীতকাল পরিবেশের জন্য একাধিক চ্যালেঞ্জ নিয়ে আসে, বিশেষ করে দূষণের ক্ষেত্রে। শীতকালের দূষণ প্রধানত শীতল তাপমাত্রা এবং বায়ুমণ্ডলীয় পরিস্থিতির দ্বারা প্রভাবিত হয়ে থাকে। এই সময় নিচের বায়ুমণ্ডল ওপরের স্তরের তুলনায় ঠাণ্ডা হয়ে যায়।

ফলে দূষণকারী পদার্থগুলো নিচের স্তরে আটকা পড়ে। শীতকালে বাতাসের গতি অপেক্ষাকৃতভাবে হ্রাস পায় এবং এর জন্য দূষণকারী কণাগুলো বাতাসে জমে থাকার সুযোগ পায়। এই সময়ে জ্বালানি পোড়ানো, যানবাহন ও শিল্প-কলকারখানা থেকে নির্গমন এবং নির্মাণকাজের পরিমাণ বৃদ্ধি পায়। ফলে দূষণও বৃদ্ধি পায়।



শীত ঋতুতে নদীর পানিপ্রবাহ কমে যাওয়ায় দূষণকারী পদার্থগুলোর ঘনত্ব বাড়ে। এ সময় অনেক কলকারখানা থেকে অপরিশোধিত বর্জ্য নদীতে চলে এসে পানিদূষণের মাত্রা তীব্র করে তোলে। শীতকালে ভূমিসংলগ্ন নাইট্রোজেন অক্সাইডস ও উদ্বায়ী জৈব যৌগের পরিমাণ বৃদ্ধি পায়। এগুলো সূর্যালোকের উপস্থিতিতে রাসায়নিক ক্রিয়ার দ্বারা ভূ-সংলগ্ন ওজোন তৈরির পরিমাণও বাড়িয়ে দেয়। উল্লেখ্য, ওজোন বিস্ফোরকধর্মী বিষাক্ত একটি গ্যাস। এই গ্যাস ভূপৃষ্ঠের কাছাকাছি অবস্থান করলে তা আমাদের স্বাস্থ্য তথা জীবনের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়ায়। জীববৈচিত্র্যের জন্যও তা ক্ষতির কারণ হয়। অথচ এই একই গ্যাস ভূপৃষ্ঠের বহু ওপরে (স্ট্র্যাটোস্ফিয়ার) পরিমাণমতো না থাকলে সেটিও জীবজগতের জন্য বিপদের কারণ হয়ে দাঁড়ায়।


শীতকালে বছরের অন্যান্য সময়ের তুলনায় বেশির ভাগ গাছপালার শারীরবৃত্তীয় পদ্ধতির কিছু পরিবর্তন দেখা যায়। এই সময় বিশেষ করে শীতপ্রধান অঞ্চলে সূর্যালোক ও তাপমাত্রা কম থাকার কারণে উদ্ভিদের সালোকসংশ্লেষণ (ফটোসিনথেসিস) প্রক্রিয়া এবং পত্ররন্ধ্রের কার্যকলাপ অনেকটা হ্রাস পায়। অনেক গাছ পাতাশূন্য হয়ে পড়ে। ফলে এই সময় শীতপ্রধান অঞ্চলের গাছপালা কর্তৃক কার্বন ডাই-অক্সাইড ও ওজোন শোষণক্ষমতা তাৎপর্যপূর্ণভাবে হ্রাস পায়। গ্রীষ্ম এবং উপগ্রীষ্মমণ্ডলীয় অঞ্চলেও শীতের সময় কার্বন ডাই-অক্সাইড ও ওজোন শোষণপ্রক্রিয়া কিছুটা হলেও বাধাগ্রস্ত হয়। বিশেষ করে এই সময় বিপুল পরিমাণ ধূলিকণা গাছের পত্ররন্ধ্র ঢেকে দেওয়ার ফলে গাছের শারীরবৃত্তীয় পদ্ধতির ওপর প্রভাব পড়তে দেখা যায়। ফলে এসব গাছপালার কার্বন ডাই-অক্সাইড ও ওজোন শোষণপ্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হয়।


প্রকৃতপক্ষে শীতকালে অনেক দেশে বায়ুদূষণ তীব্র আকার ধারণ করে। বিশেষ করে চীন, ভারত, বাংলাদেশ, পাকিস্তান, নেপাল, পোল্যান্ড, রাশিয়া, ইরান, মিসর, তুরস্ক প্রভৃতি দেশের অনেক জায়গায় এই সময় বাতাসে নানা ধরনের বস্তুকণার পরিমাণ বৃদ্ধি পায়। বায়ুদূষণ পরিমাপের জন্য সাধারণত বায়ুতে গ্যাসীয় দূষণ ও ভাসমান কঠিন কণা জনিত দূষণ বিবেচনা করা হয়। বায়ুতে ভাসমান তরল কণা, তেজষ্ক্রিয় পদার্থসহ বিভিন্ন ধরনের রশ্মির উপস্থিতিও মাপা হয়। বাতাসের মধ্যে যেসব বস্তুকণার ব্যাস ২.৫ থেকে ১০ মাইক্রোমিটার বা মাইক্রন (এক মিলিমিটারের এক হাজার ভাগের এক ভাগ), বায়ুদূষণ পরিমাপে তাদের বিশেষভাবে বিবেচনায় নেওয়া হয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশিকায় (২০২২) প্রতি ঘনফুট বাতাসে মিশে থাকা ২.৫ ও ১০ মাইক্রোমিটার ব্যাস বিশিষ্ট বস্তুকণা ও চার ধরনের গ্যাসের (ওজোন, নাইট্রোজেন ডাই-অক্সাইড, সালফার ডাই-অক্সাইড ও কার্বন মনোক্সাইড) পরিমাণের ওপর বায়ুদূষণের মাত্রা নির্ভর করে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। জাতিসংঘের পরিবেশ কর্মসূচির ওয়েবসাইটে বাতাসে মিশে থাকা ২.৫ মাইক্রোমিটার ব্যাস বিশিষ্ট বস্তুকণাকে সব থেকে বিপজ্জনক বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এই বস্তুকণা প্রতি ঘনফুট জায়গায় পাঁচ মাইক্রোগ্রামের বেশি থাকলে তাকে দূষিত বায়ু বলা যাবে এবং তা শরীরের জন্য ক্ষতিকর। বাতাসে মিশে থাকা চার ধরনের গ্যাস—ওজোন, নাইট্রোজেন ডাই-অক্সাইড, সালফার ডাই-অক্সাইড ও কার্বন মনোক্সাইডের স্বাভাবিক মাত্রা হচ্ছে যথাক্রমে ০-০.০৭০, ০-০.০৫৩, ০-০.০৭৫ ও ০-০.৯ পিপিএম (পার্টস পার মিলিয়ন)। এর কোনো একটি বা একাধিক গ্যাস উল্লিখিত স্বাভাবিক মাত্রার চেয়ে বায়ুতে যত বেশি পরিমাণ থাকবে, সেই বায়ুকে তত বেশি দূষিত বা অস্বাস্থ্যকর বলে চিহ্নিত করা হবে।


মানবসৃষ্ট কর্মকাণ্ড এবং প্রাকৃতিক কারণে নানা ধরনের বস্তুকণা তৈরি হয় এবং তা বাতাসে মিশে যায়। মানবসৃষ্ট কর্মকাণ্ডের মধ্যে রয়েছে—১. দহন কার্যক্রম (যানবাহন, শিল্প-কলকারখানা, আবাসিক ও অন্যান্য); ২. শিল্প ও কৃষি কার্যক্রম (নির্মাণ ও ধ্বংস, খনি ও খনন, কৃষি ইত্যাদি); ৩. পরিবহন সম্পর্কিত নন-এক্সহস্ট কার্যক্রম (ব্রেক, টায়ার ও রাস্তাপৃষ্ঠের ক্ষয় থেকে উৎপন্ন কণা, রাস্তায় পড়ে থাকা ধুলা বাতাসে মিশে যাওয়া); ৪. আনুষঙ্গিক কার্যক্রম (সালফার ডাই-অক্সাইড, নাইট্রোজেন ডাই-অক্সাইড, অ্যামোনিয়া, উদ্বায়ী জৈব যৌগ)। প্রাকৃতিক কারণগুলো হচ্ছে—১. দাবানল ও বায়োমাস জ্বলন (বনভূমি, তৃণভূমি, পিটল্যান্ড ইত্যাদিতে আগুন লাগা); ২. ধুলা ও মাটি (মরুভূমি ও শুষ্ক মাটি থেকে সৃষ্ট); ৩. আগ্নেয়গিরি (অগ্ন্যুৎপাতের ফলে বায়ুমণ্ডলে ছড়িয়ে পড়া ছাই ও সূক্ষ্ম কণা); ৪. জৈবকণা (উদ্ভিদ, ফানজাই এবং অণুজীব থেকে উৎপন্ন)।


জাতিসংঘের পরিবেশ কর্মসূচির প্রতিবেদন (২০২১) অনুযায়ী পৃথিবীর ৯৯ শতাংশ মানুষ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার কঠোর মানদণ্ড অনুযায়ী নিরাপদ বায়ুর মধ্যে বসবাস করতে পারছে না। আগে ধারণা করা হতো যে বায়ুদূষণের ফলে শুধু শ্বাসতন্ত্রেই নানা ধরনের রোগ হয়। কিন্তু ২০১৮ সালে ‘স্প্রিঙ্গার’ থেকে প্রকাশিত ‘ক্লিনিক্যাল হ্যান্ডবুক অব এয়ার পলিউশন রিলেটেড ডিজিজেস’ গ্রন্থের মাধ্যমে বায়ুদূষণের কারণে বহু রোগ হওয়ার কথা জানা গেছে। এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে—স্ট্রোক, ১৪ ধরনের হৃদরোগ; ফুসফুস, স্তন, মূত্রথলির ক্যান্সার; সিওপিডি, হাঁপানি, ফুসফুস সংক্রমণ; চর্মরোগ, অ্যালার্জি; ৯ ধরনের চোখের অসুখ; সংক্ষিপ্ত গর্ভাবস্থা, বন্ধ্যাত্ব, অনিয়মিত ঋতুচক্র; শিশুর জন্মকালীন রুগ্ণতা ও বৃদ্ধি ব্যাহত হওয়া; স্নায়ু বৈকল্য, ডিমেনশিয়া, আলঝেইমার্স; অন্তঃক্ষরা গ্রন্থির ক্ষতি, টাইপ-২ ডায়াবেটিস ইত্যাদি। জাতিসংঘের হিসাবে বায়ুদূষণের কারণে বছরে ৮০ লাখেরও বেশি মানুষের অকালমৃত্যু হচ্ছে।

সম্পূর্ণ আর্টিকেলটি পড়ুন

প্রতিদিন ৩৫০০+ সংবাদ পড়ুন প্রিয়-তে

আরও