রামু থেকে গঙ্গাচড়া: অভিন্ন চিত্রনাট্যে সাম্প্রদায়িক সহিংসতা

বিডি নিউজ ২৪ শাহেদ কায়েস প্রকাশিত: ৩১ জুলাই ২০২৫, ১২:১১

আবারও গঙ্গাচড়া। এবার আক্রান্ত হয়েছে আলদাদপুর বালাপাড়া গ্রামের হিন্দুরা। এর আগে ২০১৭ নভেম্বরে রংপুর জেলার এই উপজেলাটিরই ঠাকুরপাড়া গ্রামে একই রকম একটি ঘটনায় সংখ্যালঘুরা সহিংসতার শিকার হয়েছিল। সেবার ধর্ম অবমাননার অভিযোগ আনা হয়েছিল জনৈক টিটু রায়ের নামে, যিনি চাকরিসূত্রে থাকতেন নারায়ণগঞ্জে। এবার অভিযোগ তোলা হয়েছে, অপ্রাপ্ত বয়স্ক এক কিশোরের নামে।


দুজনের বিরুদ্ধেই মহানবী হয়রত মুহাম্মদ (সা.)-কে নিয়ে কটূক্তি করার অভিযোগ আনা হয়েছে। ১৭ বছরের কিশোরটি একটি বেসরকারি পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের ছাত্র; তার বাবা এলাকার পল্লী চিকিৎসক। কিশোরটি এখন জেল হাজতে আছেন। যতদূর জেনেছি টিটু রায়ও আছেন জেলে।


কক্সবাজারের রামু থেকে সর্বশেষ গঙ্গাচড়ার বালাপাড়ায় হামলা পর্যন্ত সাম্প্রদায়িক সহিংসতার একটা নতুন প্যাটার্ন তৈরি হয়েছে। রামুর ঘটনায় যে উত্তমকুমার বড়ুয়ার বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছিল, পরে প্রমাণ হয়েছে, তিনি ধর্ম অবমাননার মতো কোনো ঘটনা ঘটাননি। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরের রসরাজ দাস তো মোবাইল ফোনের ব্যবহারই জানতেন না। তবু ধরে নিলাম, উত্তম, রসরাজ, টিটু রায় এবং অপ্রাপ্ত বয়স্ক কিশোরটি সত্যি ধর্ম অবমাননা করেছেন, কিন্তু ব্যক্তির অপরাধের দায় কেন একটি ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে বহন করতে হবে–সামাজিক নিরাপত্তাহীনতার কারণে যাদের সংখ্যা নিরন্তর কমেই চলেছে।


ধর্মীয় সহিংসতার আদিপাপ লুকিয়ে আছে ১৯৪৭ সালের ভারত ভাগে। ভারত ভাগের অব্যবহিত আগে-পরে অবিভক্ত বাংলায় হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা ছিল যেন এক ভয়াবহ অভিশাপ। পাঞ্জাবের দাঙ্গা ছিল ত্রিমুখী—হিন্দু, মুসলিম ও শিখদের মধ্যে হয়েছে ওখানকার দাঙ্গা। উপমহাদেশের ইতিহাসে তো বটেই, সম্ভবত পৃথিবীর ইতিহাসেও এটি সবচেয়ে বড় ধর্মভিত্তিক বিভাজন। সাতচল্লিশের দেশভাগের সময় শুধুমাত্র ধর্মীয় পরিচয়ের কারণে লক্ষ-লক্ষ মানুষ বাস্তুচ্যুত এবং সহিংসতার শিকার হয়।


পরে হয়েছে—‘এখানে তুমি সংখ্যালঘু, ওখানে তুমি জমজমাট।’ কারণ ভারত ভাগের সঙ্গে ভাগ হয়েছে বাংলাও। বাংলার পশ্চিম অংশ ভারতের সঙ্গে থেকে যায় পশ্চিমবঙ্গ নাম নিয়ে, পূর্ব অংশ হয়ে যায় পাকিস্তানের পূর্ব পাকিস্তান। ১৯৬৪ সালে শ্রীনগরের হযরতবাল দরগার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট একটি ঘটনাকে কেন্দ্র করে পাকিস্তানজুড়ে দাঙ্গা হয়েছিল। তবে পূর্ব পাকিস্তানে এর প্রভাব পড়ে তীব্রভাবে। পূর্ব পাকিস্তানের হিন্দুরা সীমান্ত পেরিয়ে ভারতে পালিয়ে যেতে বাধ্য হন। সেই সময় থেকেই পূর্ব পাকিস্তানে সংখ্যালঘুদের জনসংখ্যা হ্রাস পেতে শুরু করে। এরই ধারাবাহিকতায় মুক্তিযুদ্ধের সময় হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ও তাদের দোসরদের নিপীড়নের ভূমি তৈরি হয়।



ভারত ভাগের কয়েক বছর পর ১৯৫১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী পূর্ব পাকিস্তানে হিন্দুরা ছিল প্রায় ২২ শতাংশ। ১৯৬১ সালের আদমশুমারিতে এই হার কিছুটা কমে দাঁড়ায় প্রায় ১৮.৫ শতাংশে। ১৯৬৪ সালের দাঙ্গার পরপরই জনসংখ্যার হার আরও কমে আসে। ১৯৭৪ সালে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম আদমশুমারিতে দেখা যায় হিন্দুদের জনসংখ্যা মোট জনসংখ্যার প্রায় ১৩.৫ শতাংশে নেমে এসেছে।


১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধে বিজয় অর্জনের মাধ্যমে একটি নতুন বাংলাদেশের সূচনা হয়েছিল—মনে করা হয়েছিল, স্বাধীন দেশে যাবতীয় সাম্প্রদায়িক ভেদরেখা মুছে যাবে। কিন্তু বাস্তবে সেই স্বপ্ন কখনো পূর্ণ হয়নি। যুদ্ধ শেষে অনেক হিন্দু পরিবার ভারতের শরণার্থী শিবির থেকে ফিরে এসে তাদের ভিটেমাটি ফিরে পায়নি। এমন খবর পাওয়ার ফলে কেউ কেউ ভারত থেকে দেশে ফেরাটাকেই নিরাপদ মনে করতে পারেনি।


প্রকৃতপক্ষে ভারত ভাগের পর থেকে হিন্দুরা বাংলার এই অংশে—অর্থাৎ একাত্তরে যে অংশটি বাংলাদেশ নামে স্বাধীনতা লাভ করে—সেখানে কখনও খুব একটা ভালো অবস্থায় ছিল না। ১৯৭৪ থেকে ২০২২ পর্যন্ত জনজরিপ বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় প্রায় ৭৫ লাখ হিন্দু হারিয়ে গেছে দেশ থেকে। ২০০১ সালের আদমশুমারিতে হিন্দুরা ছিল ৯.৬ শতাংশ। ২০১১ সালে তা কমে দাঁড়ায় ৮.৫ শতাংশে। সর্বশেষ ২০২২ সালের আদমশুমারিতে হিন্দুদের হার ৭.৯৫ শতাংশে নেমে আসে। এর প্রায় এক দশক আগে ২০০১ সালের ১ অক্টোবরের নির্বাচনের পরও হিন্দুদের টার্গেট করে ব্যাপক সহিংসতার ঘটনা ঘটেছিল। নির্বাচনি জয়োৎসবের আড়ালে চলেছিল লুটপাট, দখল ও ধর্ষণের মতো নৃশংসতা।


দেশভাগের মূল দর্শনই ছিল ধর্মভিত্তিক জাতি নির্মাণ, যা কোনোভাবেই অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ তৈরি করতে পারেনি। সেই ভাঙনের রক্তাক্ত ফলাফল আমরা পরবর্তীকালে দেখতে পেয়েছি এই ভূখণ্ডে—১৯৬৪, ১৯৭১, ২০০১, ২০১২, ২০১৬ থেকে বিভিন্ন সময়ে। ২০২৫ সালে গঙ্গাচড়া আরেকটি উদাহরণ হিসেবে যুক্ত হলো।


গত ২৬ জুলাই রংপুরের গঙ্গাচড়া উপজেলার আলদাদপুর বালাপাড়া গ্রামে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেইসবুক পোস্টে মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)–কে কটূক্তির ঘটনাকে কেন্দ্র করে যে উত্তেজনা ছড়ায়, তা পরিণত হয় সহিংসতায়। সনাতন ধর্মাবলম্বী যে কিশোরটি ওই পোস্ট দিয়েছে বলে অভিযোগ করা হচ্ছে, তার বাড়িসহ আশপাশের হিন্দু সম্প্রদায়ের ১৪টি বসতবাড়িতে হামলা ও ভাঙচুর চালানো হয়। ঘটনার পর থেকেই এলাকায় বিরাজ করছে চরম আতঙ্ক। হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলো ভীত ও উদ্বিগ্ন। অনেকে নিজেদের গরু, ছাগল, হাঁস-মুরগি ও ধান ভ্যানে করে সরিয়ে নিচ্ছেন নিরাপদ আশ্রয়ে।

সম্পূর্ণ আর্টিকেলটি পড়ুন

প্রতিদিন ৩৫০০+ সংবাদ পড়ুন প্রিয়-তে

আরও