অলিগার্করা ভবিষ্যৎ গণতন্ত্রের জন্য বিপজ্জনক

যুগান্তর ড. মাহবুব উল্লাহ প্রকাশিত: ৩১ জুলাই ২০২৫, ১০:১১

২০২৪-এর জুলাই-আগস্ট ছাত্র-জনতার অভূতপূর্ব গণ-অভ্যুত্থানের পর এক বছর অতিক্রম হতে যাচ্ছে। এখন সবার প্রশ্ন, এ বিশাল অভ্যুত্থানের পর দেশের ভবিষ্যৎ কেমন হবে? এমন প্রশ্নের জবাবে হতাশার কথা না বলাই শ্রেয়। কিন্তু কঠিন বাস্তবতাকে অগ্রাহ্য করার সুযোগ নেই। বাংলাদেশ এখন যে বাস্তবতার ওপর দাঁড়িয়ে আছে, সে অবস্থান থেকে আমূল পরিবর্তন সাধন করা না হলে বড় কিছু আশা করা যায় না। তবে যে কোনো বাস্তববোধসম্পন্ন মানুষই বলবেন, এ মুহূর্তে বাংলাদেশে আমূল পরিবর্তন আনার সুযোগ নেই। তাই আমাদের এমন দু-একটি নির্ধারক পরিবর্তনে হাত দিতে হবে-যে পরিবর্তনগুলোর ফলে দেশের রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজ ও সংস্কৃতিতে ইতিবাচক পরিবর্তনের সম্ভাবনা দেখা দেবে।


বাংলাদেশে একটি সম্ভাবনাময় ভবিষ্যতের পথে সবচেয়ে বড় অন্তরায় হলো ‘অলিগার্কি’। এটি বাংলাদেশ রাষ্ট্রের উদ্ভবের পর থেকে ধীরে ধীনে দানা বাঁধতে শুরু করে। বিভিন্ন সরকারের আমলে রাষ্ট্রীয় আনুকূল্য ও সহায়ক নীতিকে ব্যবহার করে এরা বড় হয়েছে। শেখ হাসিনার ফ্যাসিবাদী ও স্বৈরতান্ত্রিক শাসনের সাড়ে ১৫ বছরে এ অলিগার্কিকুল ফুলে-ফেঁপে শুধু বড় হয়নি, তারা ভয়ানক দৈত্যে পরিণত হয়েছে। শেখ হাসিনার সরকার যেমন ছিল দৈত্য-দানবের সরকার, তেমনি সেই সরকার নিজ রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাকে প্রলম্বিত ও অব্যাহত রাখতে অর্থনীতির ক্ষেত্রেও ভয়ংকর দৈত্য-দানবের উদ্ভব ঘটিয়েছে, যে দৈত্য-দানবগুলোকে এখন অলিগার্ক নামে অভিহিত করা হচ্ছে। সাধারণ পুঁজিবাদী অর্থনীতিতে মনোপলির সৃষ্টি হয়। মনোপলিস্টরা তাদের প্রতিদ্বন্দ্বীকে ন্যায্য ও অন্যায্য প্রতিযোগিতা ও প্রতিদ্বন্দ্বিতায় পরাজিত করে নিজের মনোপলি অবস্থান সৃষ্টি করে; এ থেকেই গড়ে ওঠে করপোরেট ক্যাপিটালিজম। তারপর এর রূপান্তর ঘটে বহুজাতিক করপোরেশনে। এগুলো এখন গ্লোবাল করপোরেশন। কিন্তু অর্থনীতিতে অলিগার্কদের উদ্ভব হয়েছে ভিন্ন এক পরিস্থিতিতে। এ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল সোভিয়েত ইউনিয়নে কমিউনিজমের পতনের পর নৈরাজ্য ও বিশৃঙ্খলার সুযোগ নিয়ে। সোভিয়েত ইউনিয়নে কমিউনিজমের পতনের পর রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন কলকারখানা, খনি, বন্দর, পরিবহণ ব্যবস্থা ইত্যাদি বেসরকারি মালিকানায় নেওয়ার প্রশ্ন ওঠে। কিন্তু কীভাবে তা সম্ভব? রাষ্ট্রীয় মালিকানাভিত্তিক একটি অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে ব্যক্তিমালিকানাধীন ব্যবস্থায় রূপান্তরের পথে বহু ধরনের অনিয়ম ও নৈরাজ্য দেখা দেয়। বিশেষ করে বরিস ইয়েলৎসিনের শাসন-ব্যর্থতার ফলে এমন গোলমেলে পরিবেশে মাফিয়া গোষ্ঠী শিল্প ও অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলো দখলে নেওয়ার প্রয়াস পায়।


বাংলাদেশে আমরা শাসন-ব্যর্থতা বা গভর্ন্যান্স ফেইলিউরের সুযোগে অনেককেই অনেক কিছু দখলে নিতে ও ভয়াবহ রকমের চাঁদাবাজিতে লিপ্ত হতে দেখি। সোভিয়েত ইউনিয়নেও কমিউনিজমের পতনের পর এ রকম একটি পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল, যদিও তার ব্যাপকতা ও বিশালতা অনেক বেশি ছিল। সোভিয়েত ইউনিয়নের মাফিয়ারা ছাড়াও আরও একটি গোষ্ঠী এ পরিস্থিতিতে তৎপর হয়ে উঠেছিল। এরা ‘নোমেনক্লেতুরা’ নামে পরিচিত। এরা সেসব আমলা, যারা অর্থনৈতিক খাতের সঙ্গে যুক্ত ছিল এবং এদের অনেকেই ছিল কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য। এরা রাজনৈতিক টালমাটাল পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে নোমেনক্লেতুরা বা নব্য উদ্যোক্তা হিসাবে আত্মপ্রকাশ করে। এরা যেহেতু অর্থনৈতিক খাতের সঙ্গে যুক্ত ছিল, সেহেতু তাদের পক্ষে উদ্ভূত পরিস্থিতিতে কলকারখানাগুলো দখলে নেওয়া এবং ব্যক্তিমালিকানায় পরিচালনা করা সহজ হয়। এক কথায়, সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং বর্তমান রাশিয়ায় যে বিশাল ধনিক গোষ্ঠীর সৃষ্টি হয়েছে, তাদের বলা হয় অলিগার্ক। এদের সঙ্গে রাষ্ট্র পরিচালনাকারীদের গভীর ও ঘনিষ্ঠ সহযোগিতা বিদ্যমান।



বাংলাদেশে যে অলিগার্ক গোষ্ঠীর উদ্ভব ঘটেছে, শেখ হাসিনার শাসনামলে তা সম্ভব হয়েছে রাষ্ট্রটিকেই দখলে নেওয়ার ফলে। একে অর্থনীতি ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ভাষায় বলা হয় State Capture. শেখ হাসিনার শাসনামলে ব্যাংকগুলো জনগণের মালিকানায় ছিল না। এগুলোর ভল্ট খুলে দেওয়া হয় অলিগার্ক গোষ্ঠীর লুণ্ঠনের জন্য। একপর্যায়ে ঋণের নামে এদের হাতে হাজার হাজার কোটি টাকা তুলে দেওয়া হয়। অনায়াসে ১০-১৫টি পরিবার লাখো কোটি টাকার মালিকে পরিণত হয়। অনেক ব্যাংক ধসে পড়ার উপক্রম হয়েছে। যারা প্রত্যক্ষভাবে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার সর্বোচ্চ স্তরে ছিল, তারাও অলিগার্কদের গায়েবি সঙ্গী হয়ে হাজার হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ করে। এ টাকা দেশে থাকেনি, প্রায় পুরোটাই বিদেশে পাচার হয়ে গেছে। এখন এ পাচার হওয়া অর্থ দেশে ফিরিয়ে আনা অসম্ভব না হলেও খুবই কঠিন।


প্রফেসর ইউনূসের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব পাওয়ার পরপরই দেশে বিভিন্ন সেক্টরে সংস্কার আনার লক্ষ্যে বেশকটি কমিশন গঠন করে। এসব কমিশন তাদের প্রতিবেদন যথাযথ কর্তৃপক্ষের কাছে দাখিল করেছে। এসব কমিশনের একটি ছিল অর্থনীতিবিষয়ক। এ কমিশনের নেতৃত্বে ছিলেন ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। তারা যে প্রতিবেদন দাখিল করেন, তার শিরোনাম ছিল-White paper on the state of Bangladesh Economy: Dissection of a Development Narrative (November 2024). এ প্রতিবেদন দাখিলের পর এই কমিশনের পক্ষ থেকে একটি সংবাদ সম্মেলন ডাকা হয়। এ সংবাদ সম্মেলনে ড. ভট্টাচার্য শেখ হাসিনার সরকারকে ‘চোরতন্ত্রের’ সরকার বলে চিহ্নিত করেন। এ প্রতিবেদনে দেখানো হয়েছে কীভাবে ও কী মাত্রায় রাষ্ট্রীয় সম্পদ অলিগার্কদের কাছে বেহাত হয়ে গেছে। ‘চোরতন্ত্র’ কথাটি, ইংরেজিতে যাকে বলা হয় kleptocracy, পরিভাষাটি বিশেষভাবে চালু করেছে বিশ্বব্যাংক তাদের দুর্নীতিসংক্রান্ত প্রকাশনায়। চুরি করাই ছিল হাসিনার সরকারের মূলমন্ত্র। তাই একে ‘চোরতন্ত্র’ বললে অন্যায় কিছু হয় না।


আসল কথা হলো, শেখ হাসিনা ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত করে রাষ্ট্রের আইন-কানুন, বিধিবিধান ও নিয়ম-নীতি দুমড়েমুচড়ে ফেলেছিলেন। রাষ্ট্র পরিণত হয়েছিল তার পৈতৃক সম্পত্তিতে। বেসরকারি খাতকে নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য রাষ্ট্র কিছু নিয়ন্ত্রণকারী বা Regulatory প্রতিষ্ঠান সৃষ্টি করে। তবে অনেক সময় অবস্থাটা এমন হয় যে, যারা নিয়ন্ত্রণ করবেন তারা বন্দি হয়ে যান যাদের নিয়ন্ত্রণ করার কথা তাদের হাতে। একে বলা হয় Regulatory Capture। তার চেয়েও অনেক বেশি মারাত্মক হলো State Capture. শেখ হাসিনার শাসনামলে বাংলাদেশ রাষ্ট্রটিকে বেহাত করে ফেলেছিল অলিগার্করা।


আগামী দিনে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র বিনির্মাণ করতে হলে জাতিকে অবশ্যই অলিগার্কদের হাত থেকে রক্ষা করতে হবে। এই অলিগার্করা এ মুহূর্তে কিছুটা কোণঠাসা অবস্থায় আছে। তবে এরা কোনোক্রমেই নিঃশেষ হয়ে যায়নি। এরা নানারকমের কায়দা কৌশল করছে আবারও পুরোনো রূপে প্রত্যাবর্তন করতে। তাই যদি হয়, তাহলে ’২৪-এর গণ-অভ্যুত্থানের সব আত্মত্যাগ, সব আত্মাহুতি, সব রক্তক্ষরণ ব্যর্থ হয়ে যাবে। অলিগার্করা নানা কৌশলে পুনর্বাসিত হওয়ার চেষ্টা করছে। একদিকে তারা পতিত ফ্যাসিবাদের সঙ্গে সম্পর্ক রক্ষা করে চলছে, অন্যদিকে তারা ভবিষ্যতে যারা রাষ্ট্রক্ষমতায় আসতে পারে, তাদের সঙ্গে সখ্য গড়ে তোলার চেষ্টা করছে। এ প্রক্রিয়ায় শতসহস্র কোটি টাকার লেনদেন হচ্ছে বলে সামাজিক মাধ্যমে অভিযোগ উঠেছে। এ অভিযোগ যদি সত্য হয়, তাহলে এর চেয়ে বেদনাদায়ক আর কিছু হতে পারে না। অলিগার্করা যদি গায়ে আঁচড় না লাগিয়ে বেঁচে যায়, তাহলে তারা আবার State Capture-এর চেষ্টা করবে। এর জন্য ভিন্ন কোনো গোষ্ঠীর সঙ্গে আঁতাত গড়ে তুলতে হলেও তারা তাতে কোনো রকম অস্বস্তিবোধ করবে না। অলিগার্কদের অক্ষত রাখার পরিণতি হবে দেশটি শিয়াল-শকুনের খাদ্যে পরিণত হওয়া। এমনটি হতে দেওয়া যায় না। কারণ আগামী দিনের সরকারের ওপর ভর করে তারা জাতির ওপর সব ধরনের বেইমানি ও বেইনসাফি চাপিয়ে দেওয়ার প্রয়াস পাবে। ফলে আমাদের আরাধ্য গণতন্ত্র দানা বাঁধতে পারবে না।

সম্পূর্ণ আর্টিকেলটি পড়ুন

প্রতিদিন ৩৫০০+ সংবাদ পড়ুন প্রিয়-তে

আরও