
ঘুষ কেউ নেয়, কেউ দেয়...
বিএনপির মতো একটি বড় দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর যখন বলেন, ‘আগে ঘুষ দিতে হতো ১ লাখ, এখন ৫ লাখ দিতে হয়’, তখন সেটা শুধু অর্থনীতিতে ঘুষের মুদ্রাস্ফীতিই নয়, বরং গভীর রাজনৈতিক-প্রশাসনিক ব্যর্থতার প্রতীক হয়ে দাঁড়ায়। এই বক্তব্য এসেছে একটি গুরুত্বপূর্ণ পরিসরে—অর্থনীতিবিদ হোসেন জিল্লুর রহমানের বই ‘অর্থনীতি, শাসন ও ক্ষমতা’ প্রকাশনার অনুষ্ঠানে, যেখানে শাসনব্যবস্থার অন্তর্নিহিত দুর্বলতাগুলো আলোচনার কেন্দ্রে ছিল। এই বক্তব্য এবং অনুষ্ঠানের আলোচনাগুলোকে ঘিরে আমরা বাংলাদেশের শাসন, দুর্নীতি এবং অর্থনৈতিক ন্যায্যতা প্রসঙ্গে কিছু গভীর বাস্তবতা অনুধাবন করতে পারি।
একজন ব্যবসায়ী যখন বিএনপির মহাসচিবকে বলেন যে ঘুষের হার পাঁচ গুণ বেড়েছে, তখন এটি নিছক সংখ্যাতাত্ত্বিক তথ্য নয়, বরং তা ইঙ্গিত করে একটি গহ্বর তৈরি হওয়া ব্যবস্থার। ১ লাখ থেকে ৫ লাখ—এটা শুধু টাকা নয়, এটা হচ্ছে একটি প্রতিষ্ঠিত হারে ঘুষ আদায়ের সংস্কৃতি। অর্থাৎ, ঘুষ এখন একটি আনঅফিশিয়াল ‘ট্যারিফ’-এ পরিণত হয়েছে, যার হার বাজারচাহিদা ও ক্ষমতার ভারসাম্যের ভিত্তিতে নির্ধারিত হয়। এটি এমন একপর্যায়ে পৌঁছেছে, যেখানে ঘুষের হারও ‘ইনফ্লেশন’-এর শিকার, কিন্তু এর পেছনে কাজ করছে অদৃশ্য অথচ প্রাতিষ্ঠানিক শক্তি।
মির্জা ফখরুল বলেছেন, ‘কোথাও কোনো সুশাসন নেই, নিয়ন্ত্রণ নেই।’ এটাকে শুধু তাঁর রাজনৈতিক বক্তব্য হিসেবে না দেখে এর বাস্তবতাকে স্বীকার করাই ভালো। ঘুষ, নিয়ন্ত্রণহীন প্রশাসন এবং ‘সিস্টেম’ ভেঙে পড়া—এই তিনটি পরস্পর সম্পর্কযুক্ত উপসর্গ। দেশে রাজনৈতিক ক্ষমতার পরিবর্তন হলেও সুশাসন প্রতিষ্ঠার পথ সুগম হয় না। পরিবর্তনের অজুহাতে অন্যায়-অনিয়মের মাত্রা বাড়ে। তাই প্রশাসন, পুলিশ ও বিচারব্যবস্থায় কোনো বড় ধরনের সংস্কার না হলে ‘ঘুষ’ই আরও প্রাতিষ্ঠানিক রূপ নেবে।
অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা, অর্থনীতিবিদ সালেহউদ্দিন আহমেদের ‘ভালো প্রতিষ্ঠান নেই বললেই চলে’, আর ‘মানুষগুলো পরিবর্তন হয়নি’—এই স্বীকারোক্তি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, এখানে ব্যক্তি নয়, প্রতিষ্ঠানকে দায়ী করা হয়েছে এবং একই সঙ্গে বলা হয়েছে যে ব্যক্তির মানসিকতা ও আচরণও অপরিবর্তিত। অর্থাৎ, সংস্কারের মাধ্যমে শুধু আইনিকাঠামো বদলানো নয়, বরং সামাজিক আচরণগত পরিবর্তনও নিশ্চিত করতে হবে। প্রশ্ন হলো, এই কঠিন কাজটি কে করবে?
মির্জা ফখরুল যখন বলেন, ‘গণতান্ত্রিক চর্চা বাদ দিয়ে বসে থাকা যাবে না’ এবং ‘চাপিয়ে দেওয়া সংস্কার নয়’, তখন তা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের দিকে ইঙ্গিত করে। অর্থাৎ, সংস্কার সফল করতে হলে সেটি হতে হবে জনগণের অংশগ্রহণে, নির্বাচনের মাধ্যমে প্রতিনিধি নির্বাচিত করে, সংসদীয় প্রক্রিয়ায়। একমাত্র গণতান্ত্রিক চর্চাই পারে দীর্ঘমেয়াদি সংস্কার নিশ্চিত করতে। এখানে তিনি কোনো র্যাডিক্যাল উত্তরণের কথা বলেননি, বরং গণতান্ত্রিক পন্থাকে সামনে এনেছেন, যা রাজনৈতিকভাবে পরিপক্বতার ইঙ্গিত দেয়। এটি হয়তো বর্তমান সরকারের সমালোচনা, কিন্তু একই সঙ্গে ভবিষ্যতের সম্ভাব্য পলিসির দিকনির্দেশনাও।
সালেহউদ্দিন আহমেদ খুব জোরালোভাবে একটি প্রশ্ন তুলেছেন: প্রধানমন্ত্রী বা সংসদ সদস্যদের ‘চেক অ্যান্ড ব্যালেন্স’ নেই—এই অবস্থা থেকে কোনো উন্নয়ন কি সত্যিই সম্ভব? এটি আমাদের সাংবিধানিক কাঠামোর মূল দুর্বলতার দিকেও ইঙ্গিত করে।
যখন একটি রাষ্ট্রে নির্বাহী বিভাগের ক্ষমতা সংসদ ও বিচার বিভাগ যথাযথভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না, তখন সুশাসন কেবল মুখের বুলি হয়ে পড়ে।
যদি রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যেও জবাবদিহি না থাকে, তবে তারা ক্ষমতায় থাকুক বা না থাকুক—ব্যবস্থার উন্নয়ন অসম্ভব। এ ক্ষেত্রে ক্ষমতাসীন পক্ষ বা বিরোধী দল—উভয়ের ওপর সমানভাবে দায়িত্ব বর্তায়।
একটি রাজনৈতিক দল যখন রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় যায়, তখন তার চরিত্র রাষ্ট্রের চরিত্র হয়ে ওঠে। আর তাই ফখরুল যখন বলেন ‘রাজনৈতিক দল জনস্বার্থে ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে’, তখন সেটা কেবল প্রতিশ্রুতি নয়, সেটা একটি পরীক্ষা। অতীতে ক্ষমতায় থাকা কোনো রাজনৈতিক দলই এই পরীক্ষায় পাস করতে পারেনি।
‘ঘুষ’ এখানে একটি উপসর্গ, কিন্তু রোগটা হচ্ছে অব্যবস্থা ও রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাব।
- ট্যাগ:
- মতামত
- ঘুষ লেনদেন